অভিমত
ত্রয়োদশ সংশোধনী : একটি ‘খাঁটি সত্যি’র প্রাদুর্ভাব
গোয়েবলসের থিওরি ছিল, একটি মিথ্যাকে ১০০ বার বললে তা সত্যি হয়ে যায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ক্ষেত্রেও এই থিওরি সম্ভবত দারুণভাবে সত্যি। সংক্ষিপ্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দুইবারের জন্য রাখা যেতে পারে- এই অভিমত তিনি নাকি পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাপিশ করে দিয়েছেন। এই অভিযোগ বিএনপির, এই অভিযোগ তুখোড় সাংবাদিকের, দুঁদে আইন বিশেষজ্ঞের, পোড় খাওয়া বুদ্ধিজীবীর, দারুণ রাজনীতি সচেতন নাগরিকের… বলতে গেলে সবার। আওয়ামী লীগ দৃশ্যত চুপ, কিন্তু দলটির নেতাদেরও এই ‘সত্যে’- দারুণ আস্থা। এবার দেখে নেই একটি মিথ্যার ‘সত্যি’তে পরিণত হওয়ার ইতিকথা-
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল রায় দেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। সংক্ষিপ্ত রায়ের আদেশে ছিল-
‘’It is hereby declared:
(1) The apple is allowed by majority without any order as to costs.
(2) The Constitution (Thirteen amendment) Act, 1996 (Act 1 of 1996) is prospectively declared void and ultra vires the Constitution.
(3) The election of the Tenth and the Eleventh Parliament may be held under the provisions of the above mentioned Thirteen Amendment on the age old principles, namely, quod alias non est licitum, necessitas licitum facit (That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful), salus populi suprema lex (safety of the people is the supreme law) and salus republicae est suprema lex (safety of the State is the Supreme law).
The parliament, however, in the meantime, is at liberty to bring necessary amendments excluding the provisions of making the former Chief Justices of Bangladesh or the Judges of the Appellate Division as the head of the Non-Party Care-taker Government.
The Judgment in detail would follow.
The connected Civil Petition for leave to appeal No. 596 of 2005 is accordingly, disposed of.’’
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সংক্ষিপ্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক উল্লেখ করে বাতিল ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ও জনস্বার্থ বিবেচনায় পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলেও অভিমত দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। সংক্ষিপ্ত রায়ে পরবর্তী দুই বার তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও তার প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতিকে না রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে চলা ঢালাও অভিযোগ হলো, সংক্ষিপ্ত রায়ে দুই বারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যেতে পারে- এই অভিমত পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি নাকি বাদ দিয়েছেন। অথচ অভিযোগকারীরা হয় MD. Abdul Mannan Vs. Bangladesh/ Civil Appeal No. 139 of 2005 with Civil Petition No. 596 of 2005-এর পূর্ণাঙ্গ রায়টি পড়ে দেখেননি, অথবা পড়ে বুঝতে পারেননি অথবা বুঝেও দিনের পর দিন মিথ্যাচার করছেন। সংক্ষিপ্ত রায়ের প্রায় ১৬ মাস পর প্রকাশিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বাংলাতেই নিজের অংশ লিখেছেন। কাজেই সেটি বুঝতে কারো খুব বেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয়, তবু এই সামান্য কষ্ট করতেও হয়তো কেউ রাজি হননি। পূর্ণাঙ্গ রায়ে একদম শেষ দিকে বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে সিদ্ধান্ত টেনেছেন সে সময়ের প্রধান বিচারপতি। দেখুন এখানে কোথায় সংক্ষিপ্ত রায়ের ‘দুই বার তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ প্রসঙ্গ তিনি রাখেননি?-
মূল রায় থেকে তুলে দিচ্ছি…
“বিজ্ঞ Amicus Curiae গণ সকলেই এই আদালতের সিনিয়র অ্যাডভোকেট। তাঁহাদের সুগভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা এবং দেশের প্রতি তাঁহাদের দায়িত্ববোধ প্রশ্নাতীত। সংখ্যাগরিষ্ঠ Amicus Curiae গণ কোন না কোন আকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখিবার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের আশঙ্কা নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাঁহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাঁহাদের আশঙ্কা আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না। যদিও তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হইয়াছে এবং ইহা অবশ্যই অবৈধ। তবুও এইরূপ আশঙ্কার কারণে সহস্র বৎসরের পুরাতন Latin Maxim, যেমন, Id Quod Alias Non Est Lictium, Neceessitas icitum Facit (That which otherwise is not lawful, necessity makes lawful), Salus opuli Est Suprema Les (Safety of the people is the Supreme Law) এবং Salus Republicae Est Suprema Lex (Safety of the State is the Supreme Law) ইহার সহায়তা লইতে হইল।
উক্ত সময়ের মধ্যে সকলেই নিজ নিজ কর্তব্য সঠিকরূপে পালন করিতে সম্পূর্ণ সজাগ ও পরিপূর্ণ দায়িত্বশীল হইবেন বলিয়া আশা করা যায়।
এইরূপ অসাধারণ পরিস্থিতির কারণে উপরোক্ত সহস্র বৎসরের পুরাতন Latin Maxim প্রয়োগ করতঃ তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬, অবৈধ হওয়া সত্বেও আগামী দশম ও একাদশ সর্বোচ্চ এই দুইটি সাধারণ নির্বাচন জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হইতে পারে।
তবে,
(১) জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণকে বাদ দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করিতে পারে, কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তাহাদিগকে সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়।
বরঞ্চ,
(২) তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে, কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের basic structure এবং এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে;
(৩) উপরে বর্ণিত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও বহাল থাকিবে।”
এই হলো সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সে সময়ের প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের জাজমেন্টের অংশ। আমি সংক্ষিপ্ত রায়ের পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ রায়েও দুই বার তত্ত্বাধায়ক সরকার রাখা বিষয়ক অভিমত পরিষ্কার দেখা যায়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংসদ চাইলে দুই বারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখতে পারে- এমন অভিমতই বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ দিয়েছেন বিচারপতি খায়রুল হক। তবে এ ধরনের কোনো সরকারও যে সংসদ সদস্যদের বাইরের কাউকে দিয়ে হওয়া উচিত নয় সেই অভিমতও তিনি দিয়েছেন। তার মানে, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দিয়েই সর্বদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে বলেছিলেন আপিল বিভাগ। এখানেও Latin Maxim-এর বিবেচনা সামনে এনে রাজনৈতিক দলগুলো রিভিউ আবেদন করলে কী হতো সেটি অন্য আলোচনা। তবে সে পথে না গিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ে দুই বারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগ গায়েব করা হয়েছে- সেই প্রচারেই গা ভাসিয়ে ভেসে গেছে সবাই। বিস্ময়কর হলো, পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি আছে তা বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের বেশিরভাগ নেতা এখনো ‘বিশ্বাস’ করতে পারেন না।
এ রায়ের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক হলো- বিচারপতি খায়রুল হক চাইলেই সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারে (যেহেতু সংসদ দুই বারের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা রাখতেও পারত) ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারক’ না রাখার নির্দেশনা এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু পরিষ্কারভাবে পূর্ণাঙ্গ রায়েও তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও সেখানে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের বাদ দিতে বলেছেন। অথচ তখনকার রীতির ধারাবাহিকতা অনুযায়ী, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাবটি প্রথম তারই পাওয়ার কথা ছিল।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন