বন্যা
পানিবন্দি উত্তরাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ
বন্যার কবলে পড়েছে উত্তরের জনপদের মানুষ। তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে গেছে লালমনরিহাট ও কুড়িগ্রামর, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারির নিম্নাঞ্চল। তিস্তার পানি গতকাল (রবিবার) বিপৎসীমার ২৫ ও ধরলার পানি ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
টানা বৃষ্টি ও উজানরে ঢলে ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বাড়ায় প্লাবিত হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের নাগশ্বেরী, ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম সদর, ফুলবাড়ী, চিলমারী, রৌমারী, রাজীবপুর ও উলিপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ৫০ ইউনিয়নের দুই শতাধকি গ্রাম।পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ।
ভারি র্বষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, আত্রাই, সুরমাসহ কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ভেসে গেছে অনেকের ঘরবাড়ি-গবাদপিশু। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। এমনকি কয়েকটি জেলায় সড়ক যোগাযোগ ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ।
এর মধ্যে রংপুরের বদরগঞ্জে গত চারদিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বন্যা দেখা দিয়েছে। চারটি নদীর পানি উপচে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়ে অন্তত লক্ষাধকি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচ শতাধকি কাঁচা ঘরবাড়ি। তলিয়ে গেছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর আমন ক্ষেত।
কুড়িগ্রামে অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ১৬টি নদ-নদীর পানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এর মধ্যে কয়েকটি পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বন্যায় জেলার নয়টি উপজেলায় সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ভুরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে পানি উঠেছে। উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোড়ক মল গ্রামে পানি উন্নয়ন র্বোডরে (পাউবো) বেড়িবাঁধের ২০ ফুট অংশ ভেঙে গিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবতি হয়েছে। এমনকি কাঁঠালবাড়ী ও হুলোখানা ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে বাংটুর ঘাট এলাকায় বাঁধ ভেঙে ওই এলাকা দিয়ে পানি ঢুকে দুই ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে অনেকের ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু। আর যাঁরা গবাদিপশুদরে বাঁচাতে পেরেছেন, সেগুলোকে নিয়ে কড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়কে আশ্রয় নিচ্ছেন। এদিকে সাপের কামড়ে ও পানিতে ডুবে মৃত্যু হচ্ছে। অপরদিকে গাইবান্ধায় অবিরাম বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গত ২৪ ঘণ্টায় গাইবান্ধার ১১টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সরকারি উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব ইউনিয়নের দুই হাজার হেক্টর আমন ধান ও পাটের জমি তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিত লোকজন ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে। সৈয়দপুরের খড়খড়িয়া নদীর বাঁ তীরে পশ্চিম পাটোয়ারীপাড়া এবং বসুনিয়া এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার বিলীন হয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
সৈয়দপুর উপজেলা সদরেরে কুন্দল, পাটোয়ারীপাড়া, নয়াবাজার, সুড়কমিলি, কাজীপাড়া, হাতিখানা, নতুন বাবুপাড়া, মিস্তিরিপিড়া এবং বাঁশবাড়ি মহল্লা প্লাবিত হয়। এসব এলাকার কোথাও কোথাও কোমর পানি। সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যেকোনো সময় বন্যার পানি ঢুকে পড়তে পারে। অপরদিকে দিনাজপুরে টানা তিনদিনের বর্ষণে পুনর্ভবা ও আত্রাই নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়ক ও দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়করে কিছু অংশ এবং পথঘাট, নিম্নাঞ্চলসহ শহরের পাড়া-মহল্লার ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। প্রবল স্রোত থাকায় দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়কের কাউগা থেকে পাঁচবাড়ী প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তায় সকাল ৭টা থেকে বড় ধরনের যান চলাচল বন্ধ । ঠাকুরগাঁওয়ে গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে টাঙ্গন, কুলকি, নাগরসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ঠাকুরগাঁওয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এতে লক্ষাধকি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলায় প্রায় ১২ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ভবনে আশ্রয় নিয়েছেনে। পৌর শহরের ডিসিপাড়া, হঠাৎপাড়া, জলেশ্বরীতলা, খালপাড়া, গোয়ালপাড়া, হাজিপাড়া, টিকিয়াপাড়াসহ আট-নয়টি মহল্লা ও সদর, বালিয়াডাঙ্গী, রানীশংকৈল, পীরগঞ্জ এবং হরিপুর উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম প্লাবতি হয়েছে। এতে রোপা আমন, সবজিক্ষেতে ও জাগ দেওয়া পাট তলিয়ে গেছে। ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া টাঙ্গন নদের পাশের বসতি তলিয়ে ঘরের আসবাব ভেসে গেছে।
নওগাঁয় মান্দা উপজেলা নুরুল্যাবাদ ইউনিয়নের পার নুরুল্যাবাদ ও নুরুল্যাবাদ উত্তরপাড়া এলাকায় দুই স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে বেড়িবাঁধের ভেতর থাকা পার নুরুল্যাবাদ, নুরুল্যাবাদ উত্তরপাড়া ও শিবচর গ্রাম প্লাবিত হয়। বন্যার পানির তোড়ে চারটি কাঁচা বাড়ি ভেঙে গেছে। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ হয়ে পড়েছে পানিবন্দি।পঞ্চগড় জেলায় গত কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টি ও নদ-নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় এই জেলার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়। এক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। জেলার চারটি উপজেলা ও একটি পৌরসভায় ১৫৮টি আশ্রয়কন্দ্রে খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২৯ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় নিয়েছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ভেসে গেছে পাট ও আমন ক্ষেত। অনেক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। তবে ভারি বৃষ্টির পাশাপাশি উজান থেকে নেমে আসা নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। এ কারণে পাঁচ উপজেলায় বন্যা পরস্থিতি উন্নতি হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলায় টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি ৪৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহতি হচ্ছে। এ কারণে কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়ছে। সদ্য রোপণ করা রোপা ধানের জমি তলিয়ে গেছে। যমুনা নদীর তীরবর্তী চৌহালী উপজেলার খাসকাউলিয়া, এনায়েতপুর এলাকার বামনগ্রাম এলাকায় নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। অপরদিকে লালমনরিহাট জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার এক লাখ ১৬ হাজার ৭৫০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ২৪০টি সরকারি প্রাথমকি বিদ্যালয়ে পাঠদান সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহতি হয়। লালমনরিহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ও মোগলহাট ইউনিয়নে অবস্থতি পাউবোর ধরলা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ বাঁধে চারটি স্থানে গত শনিবার দুপুর থেকে ও রাতের মধ্যে ভেঙে যায়। এতে ধরলা ও রতনাই নদীর পানি এক হয়ে প্রবল বেগে প্রবাহতি হচ্ছে। অপর দিকে মোগলহাট ও কুলাঘাট ইউনিয়ন ব্যাপক এলাকা জলাবদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি লালমনিরহাট পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩, ৫, ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট তিন থেকে চার ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বন্যার কারণে আজ ভোর থেকে এ বিভাগের চারটি রেল রুটের ট্রেন চলাচল সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
এভাবেই উত্তরাঞ্চলের সব মানুষ আজ পানিবন্দি। খাবার, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। যারা দিন এনে দিন খায় তাদের আহাজারি ও চোখের পানি বন্যার পানিতে মিশে যাচ্ছে। এখনো পানিবাহিত রোগ ছড়ানো শুরু হয়নি। তবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে পানিবাহিত রোগেরও প্রাদুর্ভাব দেখা দিবে। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষ বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেন। বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের ব্যবস্থা করুন। উত্তরাঞ্চলের মানুষের আহাজারি থামানোর পদক্ষেপ নেন।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।