অভিমত
অবলা গরু ও মোদির দেশে বলির রাজনীতি
বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। সত্যিই তো। সবারই একটা জায়গা আছে , যেখানে তাকে সবচেয়ে ভাল মানায়। তাহলে গরুর আসল ঠিকানা কোথায় ? ঘাসের ক্ষেত কিংবা গোয়াল ঘরে! সে মতোই তারা ছিল বা আছে। তাদের জায়গায় তারা ভালই আছে। এ নিয়ে তাদের কোন ক্ষোভ আছে বলেও শুনিনি। এই মনুষ্য সমাজে তাদের বেঁচে থাকার খুব একটা আর্তি আছে বলেও জানা যায়নি। অথচ তাদের রক্ষার নামে এখন কি কান্ডটাই না ঘটছে ভূ-ভারতে। গরু কি জানে , ঘাসের ক্ষেত কিংবা গোয়ালঘর ছেড়ে ভারতীয় রাজনীতির ময়দানে তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে।
তাকে রক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত নির্দেশ জারি করেছে। তাকে জাতীয় পশু ঘোষণা করারও পরামর্শ দিয়েছেন এক বিচারপতি। বেচারা গরুরা যদি জানতো , তাহলে বোধ হয় গর্বে চার পা মাটিতে ফেলতে পারতো না। ‘জয় মদিজি কি জয়’ হাম্বাধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলত। আর এটা শুনে প্রাণীকুলের অন্য সবাই আফসোস করে বলত, কেন যে গরু হয়ে জন্ম নিলাম না!
আমার এই ভূমিকা পড়িয়া যারা ক্ষিপ্ত হচ্ছেন , তাদের বলি খোদ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও এ গো-মাতার ভাবনা নিয়ে বিরোধ আছে। গত ৬ এপ্রিল, ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তেও বিষয়টা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ডি এন ঝা তার ‘দি মিথ অব হলি কাউ’ বইয়ে দেখিয়েছেন, প্রচীনকালে ভারতবর্ষের হিন্দু ও বৌদ্ধরাও গরুর মাংস খেত। তার মতে, আঠারো ও উনিশ শতকে গরু গো-মাতার মর্যাদা পায়। আর এর পর থেকেই ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খেলায় গরু একটি গুরুত্বপূর্ন ‘প্রতীক’ হয়ে ওঠে। ১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে গঠিত হলো গো-রক্ষা সমিতি। ১৯২৫ সালের পরে আরএসএস এর প্রেরণায় উত্তর ভারতে অনেক দাঙ্গার কারণ ছিল ‘অবলা গরু’।
ভোটের মাঠেও গরুর প্রবেশ কিন্তু কম আগে হয়নি। তার প্রভাব বঙ্গদেশেও পড়েছিল ১৯২৩ সালে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ দলকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছিলেন বাংলার প্রখ্যাত দুই নেতা ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী। তবে এর ভিত্তি ছিল ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে একটি চুক্তি। এই চুক্তির একটি ধারা ছিল , মুসলমানদের গো হত্যার বিষয়ে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা হবে না।
প্রায় ১০০ বছর পরও, একবিংশ শতাব্দীর এই সময়েও আমরা দেখি ভারতের ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ন ইস্যু ‘গরু’। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যসভা নির্বাচনগুলোতে গরু নিয়ে রাজনীতি আরো ভয়ংকর হয়েছে। গোরক্ষা সমিতির লোকেরা সারা দেশে গোশালা তৈরির যে কর্মসূচি নিয়েছে তাতে ধর্ম নয়, আছে (অপ)রাজনীতি। যুক্তি নেই, আছে উগ্রতা।
গোরক্ষা ইস্যুটি যে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সে নজির নির্বাচনের পর আরো স্পষ্ট হয়েছে। উত্তর প্রদেশে বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পরই রাজ্যে গরু পাচার ও ‘অবৈধ’ কসাইখানা বন্ধের জন্য পরিকল্পনা করা নির্দেশ দেন। অথচ এই বিজেপি উত্তর পূর্ব ভারতের কয়েক রাজ্যে নির্বাচনের আগে ঘোষণা করেছে, তারা গরু জবাই নিষিদ্ধ করবে না। কসাইখানা বন্ধের ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ নেবে না। ভারতের এক মুসলিম ব্যারিস্টার এই বিষয়টাকে মজা করে বলেছে, ‘গরু উত্তর প্রদেশে মাম্মি, আর উত্তর পূর্বে ইয়াম্মি।’
আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এই গো-রক্ষার নামে মানুষকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি ভারতে ব্যাগে গো-মাংস বহনের দায়ে জুনায়েদ নামে ১৬ বছরের এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করে একদল ‘গো-রক্ষক। শুধু তাই নয়, গত তিন মাসে এ গণপিটুনিতে অন্তত ছয়জন মুসলমানকে মেরে ফেলা হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে।
এ ঘটনায় ভারতের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। ‘নট ইন মাই নেম’ বা ‘আমার নামে নয়’ স্লোগানে রাস্তায় নেমেছে হাজারো মানুষ। গো-রক্ষার নামে সব ধরনের সহিংসতার বন্ধের জোর দাবি জানান তাঁরা। এর এটা যে শুধু গরুর প্রতি ভালোবাসা নয়, সেটাই গণমাধ্যমকে বলেছেন বিক্ষোভকর্মসূচির একজন সংগঠক কলকাতার অঞ্চিতা ঘটক। বললেন, ‘ আমাদের মনে হচ্ছে দেশে হিন্দুত্বের একটা আগ্রাসন শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে খুবই উগ্র জাতীয়তাবাদও তৈরি হচ্ছে, যার সঙ্গে আবার হিন্দু ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।’
এ ঘটনার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মুখ খুললেছিলেন। জানালেন, গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যা মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্য ছয়জনের মৃত্যুর পর তার হৃদয়ে গান্ধীবাদ জেগে উঠল। তবে খুবএকটা জোরের সঙ্গে তিনি কিন্তু বললেন না যে, যারা এসব করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বরং মিনমিনে কণ্ঠে শোনালেন অহিংস বাণী, গো-রক্ষার কথা মহাত্মা গান্ধী বা আচর্য বিনোবা ভাবের চেয়ে বেশি আর কেউ বলেননি। কিন্তু তারা কোনোভাবেই এসব কর্মকাণ্ড সমর্থন করতেন না।’
তবে রোববার ভারতে সর্বদলীয় এক বৈঠকে, গো রক্ষার নামে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেয়া হবে না। রাজ্য সরকারকেও তিনি কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।
যদিও তিনি বলেছেন, গো-রক্ষাকে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় রং দেওয়া ঠিক না। কিন্তু তিনিই আবার বলছেন, গো-রক্ষার জন্য আইন আছে। তাহলে সেটা আসলে কিসের কথা ভেবে?
তবে সত্যিটা হলো এই যে, গান্ধী থেকে শুরু করে হালের নরেন্দ্র মোদি, সবাই এই গো-মাতার দারুণ ভক্ত। তারা গরুকে দেবতার পর্যায়ে রেখেই কথা বলেছেন এবং বলছেন।
তাই তাঁরা কখনই সাহস করে বলতে পারেননি, ‘গরুকে যে দেবতা মানার মানবে, যে খাবার খাবে।’ ভারত মাতা আর গো-মাতাকে তারা বারবার গুলিয়ে ফেলেছে কি না! তার বিষফল এখন আক্রান্ত করছে গোটা ভূ-ভারতকে, রক্তে যার ইতিহাস লেখা চলছে।
তবে আশার কথা হল ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের এই হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখনো সেচ্চার আছে সেখানকার নাগরিকদের বড় একটা অংশ। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন বিরোধী দল কংগ্রেস, সংযুক্ত জনতা দল, আম আদমি পার্টি, পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমসহ অনেক রাজনৈতিক দল।
কিন্তু ভয়ের কথা হলো, নরেন্দ্র মোদি এখনো ভারতে খুব জনপ্রিয় নেতা, প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দল হিন্দুত্ববাদকেই সমর্থন করে। আর আরএসএসকে ব্যবহার করে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে। আর নরেন্দ্র মোদির পেছনে আছে সেদেশের বড় বড় সব করপোরেট প্রতিষ্ঠান আর পুঁজিপতিরা, যাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেছেন তিনি।
তাই, মোদি কী চাইছেন, কীভাবে চাইছেন- সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে সঙ্গে এটাও দেখার বিষয় মোদি আসলে কতটা পারবেন? তিনিই নিজেই যেখানে জোরালোভাবে হিন্দুত্ববাদের সমর্থক, গো-মাতার ভক্ত, সেখানে তাঁর পক্ষে গো-রক্ষা সমিতিকে কতটা দমন করা সম্ভব? বা তিনি আসলে কতটা দমন করতে চান? তার হাত কি আরএসএসে বাধা নয়? তাঁর স্পন্সর করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে কী চায়?
দিনকয়েক আগে, ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলে একটা বিজ্ঞাপন আমার নজর কাড়ল। বাবা রামদেবের কম্পানি পতঞ্জলির গাঁওয়া ঘির বিজ্ঞাপন। বলা হচ্ছে, ভারতে গো-হত্যা না হলে যে গরু পাওয়া যাবে তা ভারতের ঘিয়ের চাহিদা পূরণে ভালো ভূমিকা রাখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই পণ্যের বাজারেও যে গো-মাতার অনেক দাম সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। তাই গরু যে শুধু রাজনীতির মাঠেই শিং গুতোচ্ছে তা নয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পকেটও ভারি করছে কিন্তু। আলটিমেটলি, বাণিজ্যই কিন্তু এই দুনিয়ার শেষ কথা। আর তাই তো, বাবা রামদেব তার ধর্মীয় ইমেজ ব্যবহার করে পতঞ্জলির ব্যবসা মাত্র কয়েক বছরেই প্রায় সাত হাজার কোটির টাকার ঘরে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি গো-মাতার জয় গাইবেন না তো কে গাইবেন? সঙ্গে শিল্পা শেঠীরা থাকলে তো কথাই নেই। আর মোদিজি তো আছেনই।
গরুকে যখন গো-রক্ষা সমিতি তাদের মাতা দাবি করল, তার জবাবে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে, ‘হ্যাঁ, গরু যে আমাদের মা, তা আমি বিলক্ষণ বুঝেছি- তা না হলে এমন সব কৃতী সন্তান আর কে প্রসব করবেন?’ এখন প্রশ্ন হলো, এই কৃতী সন্তানদের হাত থেকে ভারত কি মুক্তি পাবে? নাকি ধর্ম আর পুঁজির চক্করে গো-রক্ষার নামে চলতেই থাকবে উগ্রতা, সহিংসতা? সাংবিধানিকভাবে ধর্ম-নিরপেক্ষ ভারত কি পারবে তার সংবিধান সমুন্নত রাখতে? এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই আমাদেরও ভাবাচ্ছে। কারণ, ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হারালে গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।