অভিমত
‘ভরসা রাখুন রাজনীতির ওপর’
গ্রামদেশে একটা কথা আছে, ‘কিসের সাথে কি, পান্তা ভাতে ঘি!’ তাও খায় লোকজন। এটা না হয় মানাও যায়। কারণ একজনের খাওয়ায় তো অন্য কারো কিছু যায়-আসে না। কিন্তু রাজনীতিতে নিয়মনীতির বা নীতি-নৈতিকতার একটু দরকার আছে বটে। এতে যা তা মেলালে, যাঁতা খেতে হয়। এর ফল ভালো হয় না। যেমন হবে না হালের ‘ভরসা রাখুন নৌকার ওপর’-এর বিপরীতে ‘ভরসা রাখুন আল্লাহর ওপর’ স্লোগানের অসম তুলনায়। হয়নি আগেও।
তাই আগের কথাই আগে বলি। এ দেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো এই ব্যবহারটা আসলে শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে ‘অপব্যবহার’। বেশির ভাগ সময় দেখা গেছে, ক্ষমতাশালীরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ধর্মকে ‘অপব্যবহার’ করেছেন মাত্র।
এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনীতিতে ধর্মের (অপ)ব্যবহার— এই দুইয়ের মধ্যে বিশাল ফারাক আছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তবে এর চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হলো রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা। এটা যেমন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোও করতে পারে, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলোও করতে পারে। ধর্মকে রাজনীতিতে নানারূপে ব্যবহার করা হয়, আমার এই লেখায় মূলত নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রচারণা, বিশেষ করে, স্লোগানে নিবদ্ধ থাকবে।
সেই ৫৪’ সালের নির্বাচনেও ভাসানীর মতো মাওলানার বিরুদ্ধে ছড়ানো হয়েছে ‘নাস্তিকতার’ কুৎসা। যুক্তফ্রন্টের নেতাদের বলা হতো ‘হিন্দুস্তানের চর’। এও নাকি বল হতো যে, যুক্তফ্রন্টে ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। কী দেখা গেল, রাজনৈতিক লড়াইয়ে জেতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার চেষ্টা!
এসব কর্মকাণ্ড সত্তরের নির্বাচন বা তার পরবর্তী সময়েও হয়েছে। ‘জয় বাংলা’কে কটাক্ষ করে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল স্লোগান দিত ‘জয় বাংলা, জয় হিন্দ/ লুঙ্গি খুলে ধুতি পিন্দ’।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ধর্মের (অপ)ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ তুলে ধরলেন তাঁর নতুন স্লোগান, ‘ধর্মকর্ম গণতন্ত্র’। এই যাত্রায় দেশের পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য অযাচিতভাবে ধর্মকে আরো সামনে নিয়ে আসে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে তারা ক্ষমতার সময়কে প্রলম্বিত করতে চাইল। বহু ধর্মের মানুষের এই দেশের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বদলে উদ্ভট রাষ্ট্রধর্মের আমদানি করল অনেকটা পাকিস্তানি স্টাইলে।
ধর্মের এই নতুন ব্যবহার পরবর্তী গণতান্ত্রিক সময়কেও প্রভাবিত করলো। ধর্মভিত্তিক দলগুলো, বিএনপি, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ ও বামদের বিরুদ্ধে ধর্মকে ব্যবহার করা শুরু করল আগের চেয়েও মারাত্মকভাবে। এই অবস্থায় ক্ষমতা থেকে আপাত দূরে বামপন্থীরা ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে অনড় থাকল।
কিন্তু ক্ষমতার সমীকরণে আওয়ামী লীগকে তার ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শিক অবস্থান সত্ত্বেও আপস করতে হলো বিভিন্ন সময়। কখনো কখনো সেও ব্যবহার করছে ধর্মকে।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের নবযাত্রার সূচনাকালেও আমরা দেখি বিএনপি ও অন্যান্য আওয়ামী বিরোধী শক্তি স্লোগান তুলল, ‘সোনার বাংলা, সোনার ধান, নৌকা যাবে হিন্দুস্তান’। ভারতকে হিন্দুস্তান হিসেবে তুলে ধরে একই সঙ্গে ভারত-বিরোধিতা ও হিন্দু বিরোধিতা, এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা। তখন থেকেই শুরু করে এখন পর্যন্ত নির্বাচন এলে প্রচার চালানো হয়, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশে ইসলাম থাকবে না’। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতায় আমরা দেখি, ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে দুটি স্লোগান। একটি, আগামী নির্বাচণকে সামনে রেখে ‘ভরসা রাখুন নৌকার ওপর’। দ্বিতীয়টি ‘ভরসা রাখুন আল্লাহর ওপর’।
আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক যদি গাঁধা (আমেরিকায় ডেমোক্রেটদের প্রতীক) হতো? তাহলে কিন্তু তাঁরা বলতেন, ভরসা রাখুন গাঁধার ওপর। এখানে খুব সরলভাবে বলা হয়েছে দলীয় প্রতীক হিসেবে আগামী নির্বাচনে নৌকার ওপর আস্থা রাখুন। এখন আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কি আল্লাহর ওপর আস্থা নেই? তাঁরা কি ধর্মকর্ম করেন না? এ রকম প্রশ্ন কেউ তুলতেই পারেন।
পদার্থবিজ্ঞানেই মনে হয় পড়েছিলাম। দুটি ভিন্ন রাশির কখনো তুলনা হয় না। সমাজবিজ্ঞানেও কথাটা একই। বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে নৌকার তুলনা হতে পারে ধানের শীষ, লাঙল, কাঁস্তে ইত্যাদি। নৌকায় আপনার ভরসা না থাকতে পারে। হয়তো আপনার ভরসা ধানের শীষে বা অন্য প্রতীকে। আপনি সাহস করে সেটাই বলেন।
রাজনীতির জবাব রাজনীতি দিয়ে দেওয়া উচিত। ব্যালট বাক্সে নৌকার প্রতিপক্ষ হিসেবে ধানের শীষ বা অন্যান্য প্রতীকই থাকে। এই সহজ বিষয়টা অস্বীকার করে বা না বোঝার ভান করে, তাকে ধর্মীয়ভাবে ব্যাখ্যা করা রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা ও হীনমন্যতারই পরিচায়ক। এতে দলের লাভ হয় না, বরং ক্ষতিই হয়। মানুষকে এত বোকা ভাবার কিছু নেই। এ দেশের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও সমর্থক (মুসলমান) ধর্ম পালন করে। তাদের আল্লাহর ওপর ভরসা নাই এটা ভাবা বোকামি বটে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে শুধু মুসলমানরাই বসবাস করেন না। অন্য ধর্মের মানুষও বসবাস করেন। আর একটা দল সবার জন্য। সবাই এর সমর্থক হতে পারে। বিএনপির মতো দলেও অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসী নেতা ও অনেক কর্মী আছেন। কোনো দলীয় প্রতীকের প্রতি তাদের সমর্থকদের ভরসা করা মানে কি আল্লাহর ওপর ভরসা না করা? আমরা চলতে ফিরতে অনেকেই বলে থাকি, আমার ওপর ভরসা রাখুন। এর মানে আল্লাহকে অস্বীকার করা নয়। একই শব্দ নানাভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।
তাই যারা এখন এসব করছেন বা আগেও করেছেন, তারা না ভালো করতে পেরেছেন ধর্মের, না দলের। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা না করলে রাজনৈতিক দৈন্যই ফুটে উঠবে। সঙ্গে এটা মনে রাখাও জরুরি যে সেই ১৯৫৪ সাল (এর আগেও ছিল) থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচনে ধর্মীয় স্লোগান খুব একটা কাজে লাগেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করে বর্জন করেছে। তবে একটু একটু করে হলেও এ ধরনের কর্মকাণ্ড রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়িয়েছে। বিপদও বাড়াচ্ছে।
রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই প্রতিহত করতে হয়। রাজনীতির বিপরীতে ধর্মের ব্যবহার অতি বিপজ্জনক।
এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিই, এ বছরের জানুয়ারি মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন, ঠিক যখন সে দেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের দামামা বাজছে। রায়ে বলা হয়েছে, ‘ব্যক্তির সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্কটি একান্তই স্বতন্ত্র বিষয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ধর্মের কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়, কারণ নির্বাচন একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রক্রিয়া। ধর্ম গোত্র, বর্ণ ও ভাষার নামে ভোট চাওয়া যাবে না।’
আসলেই তাই। রাজনীতির খেলা রাজনীতির মাঠেই হওয়া উচিত। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে রাজনীতি দিয়েই ঘায়েল করতে হয়। সেখানে ধর্মকে টেনে আনা ঘোর অমঙ্গলেরই লক্ষণ। আর এই সত্যটা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব ততই আমাদের মঙ্গল।
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।