সবাই খাচ্ছি ভেজালের বিষ
২৫-৩০ বছর আগের সত্য একটি ঘটনা। এক বিড়ি-সিগারেট কোম্পানির শীর্ষ কর্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ঢাকার এক প্রবীণ সাংবাদিকের। কথায় কথায় ঠোঁটকাটা সাংবাদিক সিগারেট কোম্পানির সেই কর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা শতকোটি টাকা কামাচ্ছেন, আর লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আয়ের পরিসংখ্যানের সঙ্গে কতজনকে প্রতিবছর মৃত্যুর সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, সেটার একটা পরিসংখ্যান থাকা দরকার ছিল।
কথাটা শুনে কর্মকর্তা মোটেও বিব্রত হলেন না। বরং বাড়তি সতর্কতার জন্য নিজে গিয়ে রুমের দরজাটা আটকে দিয়ে এসে ফিসফিস করে সাংবাদিককে বললেন, ভাই, অব দ্য রেকর্ডে একটা কথা বলি, আমাদের বিড়ি-সিগারেটে ৮০%ই তামাক নেই। সেগুলো আসলে বেগুনের পাতা। ফলে মৃত্যুঝুঁকি কম।
সাংবাদিক থ বনে গেলেন।
এ রকম আরেকটি সত্য ঘটনা।
গত বছর মশক নিধন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের এক সেমিনারে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে এক ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে দিলেন আরেক মজার ঘটনার বর্ণনা। তিনি একবার মশা মারার এক কয়েল কোম্পানির আন্ডারগ্রাউন্ড কারখানায় অভিযান চালালেন। কারখানাটির কোনো সনদ ছিল না। বাড়িওয়ালা বেশি ভাড়া পেয়ে কারখানার জন্য ভাড়া দিয়েছেন। ফলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে দুজনকেই জরিমানা করা হলো।
কারখানা মালিক বারবার অনুরোধ করছিলেন অন্তত তাঁর একটি কথা যেন শোনা হয়। এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট শুনবেনই না। যেহেতু মোবাইল কোর্ট, ফলে যতবার কারখানার মালিক অনুরোধ করেন, তাঁর জরিমানা তত বাড়তেই থাকে। একপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ঠিক আছে, বলে ফেলেন কী অনুরোধ আপনার।
কারখানার মালিক বললেন, ‘স্যার, আমার কয়েলে শুধু ধোঁয়া হয়, মশা মরে না; মানুষের ক্ষতি তো দূরে থাক। কারণ এতে কেমিক্যাল নাই। শুধু নারকেলের ছোবড়া, শুকনা গোবর আর কয়েলের ফ্লেবার দিয়ে এটা বানানো হয়।’
শুনে ম্যাজিস্ট্রেট থ।
এ রকম ভেজাল জিনিসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে, দেশের জনগণের জন্য তা মঙ্গলই হতো। কিন্তু নিত্যভোগ্য পণ্যের ভেজালের এই সাম্রাজ্যে এখন তো ভেজাল সিগারেট বা কয়েল নয়; বড় হুমকি হয়ে উঠেছে বিষাক্ত খাদ্যপণ্য। সকালের নাশতার টেবিলের কলাটা থেকে রাতের ডিনার টেবিলের তরকারির মসলাটা, কোথায় নেই ভেজালের বিষ?
চালে মেশানো হয় বিষাক্ত কেমিক্যাল ক্যাডমিয়াম। আটায় মেশানো হয় চক পাউডার। পোলট্রি গোশত ও ডিমে অহরহই পাওয়া যায় সহনীয় মাত্রার তিন-চারগুণ বেশি ক্রোমিয়াম। গরু মোটাতাজা করার জন্য খাওয়ানো হয় স্টেরয়েড ট্যাবলেট। মাছ, গোশত, দুধ ও ফলে মেশানো হয় মরণঘাতী ফরমালিন। মাছের নাড়িভুঁড়িতে ইনজেকশন দিয়ে ফরমালিন নামক বিষ ঢোকানো হয়। আরো অভিনব কায়দায় বরফ তৈরির সময় কারখানায় ফরমালিন মেশানো হয়। তারপর ওই বরফে মাছ সংরক্ষণ করা হয়। দুধ যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য এতে দেওয়া হয় ফরমালিন। অসাধু ব্যবসায়ীদের এই কাণ্ডকীর্তি শুনলে গা শিউরে উঠবে।
ভেজাল ও নকল পণ্যের কোনো হিসাব নেই এ দেশে। রাজধানীর কথা বাদই দিলাম। সারা দেশের মফস্বল এবং গ্রামের দোকানগুলোতে খোঁজ নিলে দেখা যায়, সেখানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে নানা খাদ্যপণ্যের প্যাকেট। বোম্বে চানাচুরের নকল বোম্ভে, বাম্বা; ট্যাংগো জুসের নকল ট্যাংগি বা টোংগা আরো কত নামের প্যাকেট দোকানে দোকানে শোভা পায়। এক চানাচুর আর জুসেরই যদি এই অবস্থা হয়, বাকি পণ্যের অবস্থা তাহলে কী হতে পারে। এগুলো মুখে দিলে কৃত্রিম একটা গন্ধ আসে। পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান বলতে সেখানে কিছু থাকে না।
এমনিতে আসল কোম্পানির খাদ্যপণ্যই মুখে দেওয়া যায় না; সেগুলোর নকল ব্র্যান্ডের কী অবস্থা, তা অনুমানের বাইরে। তারপরও শহর-গ্রাম-মফস্বলের সরল মানুষজন গোগ্রাসে গিলছে এসব ক্ষতিকর খাবার। দেশের ১৬ কোটি মানুষ আজ ভেজাল ও বিষযুক্ত খাদ্যপণ্যের কারণে এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জীবন কাটাচ্ছে। এর ফলে দিনদিন বাড়ছে দুরারোগ্য নানা রোগ-ব্যাধি।
নাশতার টেবিলে পরিবেশিত কলাটায় কি ১৫-২০ বছর আগের সেই স্বাদ-ঘ্রাণটা পাচ্ছেন? পাচ্ছেন না। পাবেন কীভাবে। কলায় দেওয়া হচ্ছে বিষাক্ত স্প্রে। কলা জন্ম থেকেই জ্বলছে বিষের ক্রিয়ায়। এ রকম জন্ম থেকেই বিষে জর্জরিত আনারস, আম, জাম, তরমুজ, পেঁপে সব মৌসুমি ফলই। কোনো ফলই বিষমুক্ত থাকতে পারছে না। এসব খেয়ে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে মানুষ। সবাই নির্বিকার।
আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব নিয়ে পত্রপত্রিকায় জোরালো কোনো লেখালেখি নেই। সংবাদ হিসেবে এটার দাম নেই। ফলে, সরকারগুলোও জনস্বাস্থ্য নিয়ে বড় পদক্ষেপ নেয় না। তারা রুটিনমাফিক কিছু অভিযান চালায়। সামান্য জেল, জরিমানায় সেই উদ্যোগ কিছুদিনের মধ্যে চাপা পড়ে যায়।
খাদ্য নিয়ে ভয়ানক খেলা হচ্ছে এ দেশে। ভেজাল ও নকল ছাড়া খাদ্য মেলে না কোথাও। এই ভেজাল খেয়ে নানা জটিল রোগ নিয়ে বড় হচ্ছে প্রজন্ম। ফলে ক্যানসার, কিডনি, হার্টের জটিল রোগ নিয়ে তারা পাড়ি দিচ্ছে ভারত, মালয়েশিয়া, সিংগাপুরের হাসপাতালগুলোতে। এক সময়ের স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত মুহূর্তেই দুরারোগ্য ব্যধির চিকিৎসা করতে ফতুর হচ্ছে। একপর্যায়ে মারা যাচ্ছে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি। ফতুর হওয়া ওই পরিবারে নেমে আসছে হতাশার অন্ধকার।
দেশে নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকর করেছে সরকার, যাতে খাদ্যে ভেজালের জন্য পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ব্যস, এই টুকুই। কাগজে-কলমে আইনটি আছে, এটিই সার। কিন্তু তার বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত লোক নেই। অথচ সারা বিশ্বেই খাদ্যে ভেজাল মেশানোর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান পর্যন্ত রয়েছে।
খাদ্যপণ্যে ভেজাল পরীক্ষা ও মনিটর করার জন্য বিএসটিআই নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান আছে। দেশের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র এই প্রতিষ্ঠান নিজেই জানে না এত বিষ ও ভেজালের ভিড়ে আসলে তাদের কী করা উচিত, কোথা থেকে শুরু করা উচিত। তাদের সেই সামর্থ্যও নেই। এ যেন হাতির সঙ্গে পিঁপড়ার যুদ্ধ।
দেশে নানা সমস্যা থাকলেও সেগুলোকে বড় সমস্যা বলে আমি মনে করি না। আমি দুটো সমস্যাকে সবচেয়ে হুমকি মনে করি, তার একটি হলো এই ভেজাল, ফরমালিনের বিষযুক্ত খাদ্যপণ্য। দ্বিতীয়টি হলো ফরমালিনযুক্ত মানহীন শিক্ষাব্যবস্থা। এর একটি শারীরিকভাবে পঙ্গু, বিকলাঙ্গ এমনকি মৃত্যু উপহার দিচ্ছে প্রতিনিয়ত; দ্বিতীয়টি চিন্তাচেতনায় বিকলাঙ্গ আর উন্মাদ একটি জাতি উপহার দিচ্ছে।
বাঁচতে চাইলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে চাইলে তাই সবার আগে খাদ্যপণ্য আর শিক্ষাকে বাঁচাতে হবে। না হলে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ একটি জাতির জন্যই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
himel_tangail@yahoo.com