অভিমত
আসুন অন্ধকারে প্রবেশ করি
২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়। একটি ভিডিও ক্লিপিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলেছিল। সচেতন মানুষের ভেতরে জন্মেছিল ক্ষোভ।
ছিঃ ছিঃ রব উঠেছিল নারীমহলে।
মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন বাঙালি নারীদের নিয়ে। কবি সুফিয়া কামাল আলোর মশাল জ্বালিয়ে বাঙালি নারীকে ঘর থেকে বের হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই আলোর নিচে অনেক সাহসী নারী এগিয়ে এসেছেন। নিজেদের আর চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে একজন পুরুষের মতোই নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখেছেন এবং অন্য আট-দশজন নারীকে স্বপ্ন দেখতে সাহস জুগিয়েছেন। সেই সাহস জোগানোর কারণে আমরা পেয়েছি শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, রওশন এরশাদ, মতিয়া চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরীর মতো নেত্রী। যাঁরা বাংলাদেশকে নিয়ে ভেবেছেন এখনো ভাবছেন। তাঁরাও দাঁড়িয়েছেন রাজপথে। দেশকে গড়ার জন্য শ্রম চিন্তা ঢেলেছেন।
কিন্তু সেই ভিডিও ক্লিপিং এ আমরা কী দেখেছিলাম? কী শুনেছিলাম? একটু স্মরণে আনার চেষ্টা করি। দেখি আমাদের স্মৃতিশক্তি আদৌ আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে কি না। নাকি প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে আমাদের চেতনাবোধ ও মনন।
প্রিয় পাঠক, শুনি সেই ক্লিপিয়ের অংশবিশেষ।[কখনো আপনি কখনো তুমি করে বলছেন।] হুজুর যেভাবে বলছেন...
‘এই মহিলারা, ঘরের চার দিউয়ারির মধ্যে তোমরা থাক। ঘরের বাহিরে ঘুরাফেরা করিও না। কে বলছে? আল্লাহপাক বলছে। হুজুরের আগের জামানায় মহিলারা বেপর্দায় চলাফেরা করত। ঘর থেকে বাইর হইও না তোমরা। উলঙ্গ অবস্থায় ঘুরাফেরা করিও না রাস্তাঘাটে, হাটে-মাঠে। সাবধান, মার্কেটিং করতে যাবে না। ছেলে আছে, স্বামী আছে এদের বলবা মার্কেটিং করার জন্য, তোমরা কেন যাইবা? তোমরা শুধু স্বামীকে অর্ডার করবে এই জিনিস আন, ওই জিনিস আন, এই জিনিস নিয়া আস। অর্ডার করবেন ছেলেকে, অর্ডার করবেন বইসা বইসা, আপনি কেন কষ্ট করবেন? আপনি স্বামীর ঘরের মধ্যে থাইকা স্বামীর আসবাবপত্র এগুলা হেফাজত কইরবেন। ছেলেমেয়ে, ছেলেসন্তানকে লালন পালন করবেন। এগুলা আপনার কাজ। আপনে বাহিরে কেন যাবেন?’
আবার তিনি বলছেন...
‘আপনার মেয়েকে কেন দিচ্ছেন গার্মেন্টসে চাকরি করার জন্য? ফজরে ৭/৮টা বাজে চলে যায়, রাত ৮/১০/১২টায় আসে না। কোন পুরুষের সঙ্গে ঘোরাফেরা করতেছে তুমি তো জান না। কতজনের মধ্যে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে, আপনে তো জানেন না। জেনা কইরা কইরা টাকা রোজগার করতেছে, কী বরকত হবে?’
‘মেয়েরা স্কুলে, কলেজে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে। আরে ক্লাস ফোর ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করান। বিবাহ শাদি দিলে স্বামীর টাকা পয়সা হিসাব কইরতে পারে, অতটুকু দরকার। বেশি বেশি আপনার মেয়েকে আইজকা স্কুলে কলেজে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করাইতাছেন, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেছেন। কিছুদিন পরে আপনার মেয়ে স্বামী একটা নিজে নিজে ধরি নিবে, লাভ ম্যারেজ/ কোট ম্যারেজ করি চলি যাবে। আপনার কথা স্মরণ করবে না।’
পাঠক, হজুর আরো অনেক কথা বলেছেন সেই ক্লিপিংয়ে। সবটুকু লিখতে রুচিতে বাধছে। এমনিতেই মনে হচ্ছে অনেক বেশিই লিখে ফেলেছি।
আপনারা সচেতন। নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি নেই কোন হুজুর এই ওয়াজ ফরমাইছেন। তিনি অনেক কামেল মানুষ। বর্তমানে তার অনেক কদর।
যে স্বপ্ন দেখেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সোনার বাংলাকে নিয়ে, সেই বাংলা কোন অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে। সেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অনেক সাধারণ মানুষ।
যা হোক আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের দুশ্চিন্তায় জাতির কিছু যায় আসে না। দেশকে নিয়ে ভাবার অনেক বড় বড় মানুষ রয়েছে। যারা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। যারা কথায় কথায় প্রগতির কথা বলে, তারাই ভাববে দেশ আসলে কোন দিকে যাচ্ছে।
অন্ধকারের দিকে যাওয়ার জন্য মনকে তৈরি করছি। দেশের সব ভাস্কর্য ভেঙে যাবে কিছুদিনের মধ্যে, মন তৈরি থেক, নারীরা ঘরের ভেতর থাকবে, মন তৈরি থেক। পাঠ্যপুস্তকে আরেক দফা সংস্কার হবে, মন তৈরি থেক।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।