ছোটদের রবীন্দ্রনাথ
‘এক যে ছিল চাঁদের কোণায়
চরকা কাটা বুড়ি,
পুরাণে তার বয়স লেখে
সাতশ হাজার কুড়ি।’
এই ছড়াটি শোনেনি এমন মানুষ খুবই কম আছে। কল্পনার ঘুড়িকে যিনি ইচ্ছামতো মনের আকাশে ছেড়ে দিতে পারতেন, রচনা করতে পারতেন অসাধারণ সুন্দর সব ছড়া, গল্প, নাটক, উপন্যাস—তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অনেক ছোটবেলা থেকেই ছেলেটি ছিল খুব একা। রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি ছিল তাঁর। ছিল অসংখ্য চাকর-বাকর। কিন্তু তাঁর সঙ্গে একটু খেলবে, একটু গল্প করবে এমন লোকের ছিল খুব অভাব। এই ছেলেটির ছিল অসাধারণ গুণ। একপলকেই লিখে ফেলতে পারত অসাধারণ সব কবিতা। নিজে মাস্টার সেজে পড়াত তাঁর বিড়াল ছানাটিকে। বই পড়তে সে অনেক ভালোবাসত। বদ্ধ ঘরে তাঁর ভালো লাগত না। কিন্তু বাইরে যাওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না। সে শুধু মন খুলে কল্পনা করতে পারত। একা থাকার কষ্ট নিয়ে বড় হয়েছিল বলেই ছোটদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। বড় হয়ে সেই হলো মস্ত কবি, নাট্যকার, ছড়াকার, ঔপন্যাসিক। আজ তাঁকে আমরা সবাই চিনি, ভালোবাসি, সম্মান করি। তাঁর নাম হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৬১ সালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে তাঁর জন্ম।
ছোটদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তিনি তাঁর হারানো শৈশবে বারবার ফিরে যেতে চেয়েছেন ছোটদের মাধ্যমে। ফিরে যেতে চেয়েছেন আনন্দের দিনগুলোতে। ছোটদের ভালোবাসতেন বলেই তিনি কল্পনার রাজ্যে ছোটদের মতো করেই বিচরণ করতেন। তাঁর অজস্র কবিতা, ছড়া আজো আমাদের কণ্ঠস্থ। ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় ছোট বালকটির অসাধারণ বীরত্ব ছোট-বড় সকলকেই মুগ্ধ করে। আমরা শিহরিত হই যখন পড়ি—
‘কি ভয়ানক লড়াই হল মা যে
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।’ (বীরপুরুষ)
তাঁর ছড়ায় ছড়িয়ে রয়েছে মজা, মিশে রয়েছে অদ্ভুত সব কাহিনী। তিনি কখনো হেঁটেছেন বাস্তব জগতে, আবার কখনো বিচরণ করেছেন কল্পনার জগতে। শিশুদের মনকে বুঝতেন বলেই তাদের উপযোগী রচনায় তিনি ছিলেন দক্ষ। তাঁর ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছড়া’ ইত্যাদি বই ছোটদের আনন্দদানে সার্থকতা অর্জন করেছে। ছোটদের জন্য তিনি কখনো ছোট হয়েছেন, আবার কখনো নিজে ছোটদের উদ্দেশে বড় হয়ে লিখেছেন। যখন আমরা পড়ি—
‘তুই কি ভাবিস দিন রাত্রি খেলতে আমার মন?
কক্খনো তা সত্যি না মা আমার কথা শোন। ( খেলাভোলা)
তখন মনে হয় কোনো ছোট শিশুই বুঝি মায়ের কাছে নিজের আকুল আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে। যখন আবৃত্তি করি—
‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।’ (তালগাছ)
তখন মনে হয়, কোনো চিরপরিচিত গ্রামের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তালগাছটা একটা মানুষ হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো আবার তিনি হয়ে গেছেন মাঝি। বলেছেন—
‘আমার যেতে ইচ্ছে করে
নদীটির ওই পাড়ে,
যেথায় ধারে ধারে
বাঁশের খুঁটায় ডিঙি নৌকা
বাঁধা সারে সারে।’ (মাঝি)
এভাবে বারবার ছোটদের মতো হয়ে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ছোটদের ছড়া। শুধু কি ছড়া? তিনি নাটকও রচনা করেছেন ছোটদের জন্য। তাঁর ‘ডাকঘর’ নাটকটি সবার কাছেই অনেক প্রিয়। অমল নামের ছোট্ট ছেলেটির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার প্রত্যাশা সব শিশুর মনঃবাসনাকেই প্রকাশ করে। যখন দইওয়ালা বলে—
‘দই ! দই ! দই নেবে দই...’
তখন মনে হয়, আমাদের ঠিক পাশ দিয়ে যেন দইয়ের ডুগি নিয়ে ছুটে চলেছে কোনো লাল মাটির দেশের দইওয়ালা।
ছোটদের জন্য তিনি ছিলেন অসাধারণ এক গল্পকার। ছোটদের জন্য তিনি অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প লিখেছেন। তাঁর ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের কথা যে একবার পড়ে সে আর তাকে ভুলতে পারে না। তার শেষ কথা—
‘মা, আমার ছুটি হয়েছে মা...’
পড়ে ছোট-বড় সবার চোখেই জল চলে আসে। ‘গল্পসল্প’ বইয়ের ‘রাজার বাড়ি’, ‘বড়ো খবর’, ‘পরী’, ‘আরো সত্য’, ‘বাচস্পতি’ ইত্যাদি গল্প ছোটদের যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি ‘সে’ বইটির জলে ডুবে মরার গল্প, শেয়ালের মানুষ হওয়ার গল্প, বাঘের গল্প, বনমানুষের মাথা ঠোকার গল্প, গেছো-বাবার গল্প ইত্যাদি গল্প আমাদের অসাধারণ আনন্দ দান করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল বড়দের জন্যই নিজেকে নিবেদন করেননি। ছোটদের জন্যও ছিলেন সর্বদা নিয়োজিত। তিনি ছোটদের ভালোবাসতেন বলেই ছোটরা তাঁকে ভালোবাসতে পেরেছে। ছোটদের উপযোগী সাহিত্য তিনিই প্রথম সমৃদ্ধ করে তুলতে সচেষ্ট হন। উপহার দেন অসাধারণ সব বই। তাই রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশ্বকবিই নন, তিনি ছোটদের রবীন্দ্রনাথও বটে।