ঢাকার যানজট মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর উপায় চিহ্নিত

ঢাকার যানজট মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর পন্থার ওপর গুরুত্বারোপ করে নতুন প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার, বাংলাদেশ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণপরিবহনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ঢাকার বাস ব্যবস্থার উন্নতিসাধনের মাধ্যমেই সবচেয়ে কম খরচে এই শহরের যানজট মোকাবিলা করা সম্ভব।
কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের ‘বাংলাদেশের অগ্রাধিকার’ শীর্ষক প্রকল্পের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের জন্য শ্রেষ্ঠ নীতিমালা চিহ্নিত করা। এ খাতে ব্যয়িত প্রতি টাকা সর্বোচ্চ কল্যাণে ব্যয় করা।
ব্র্যাকের সহযোগিতায়, কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার, বাংলাদেশ, বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদদের দায়িত্ব দিয়েছে ৭৮টি বাংলাদেশি প্রকল্পের জন্য ব্যয় এবং সুবিধাগুলো খতিয়ে দেখার জন্য।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ফিন কিডল্যান্ডসহ এক দল দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদ এই গবেষণা বিশ্লেষণ করে দেখছেন এবং বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগগুলো চিহ্নিত করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ লাখ, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১.৮ কোটিতে। টোকিও, সাংহাই, মুম্বাই অথবা অন্য সব প্রধান শহরগুলোর তুলনায় এই শহর অনেক বেশি ঘনবসতিপূর্ণ। রাজধানীর প্রবৃদ্ধি আংশিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করে, যা বছরে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে বেড়েছে। শহরের পরিবহন ব্যবস্থা, যেভাবেই হোক, বহাল থাকেনি, আর ঢাকায় এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের অনেকাংশ থাকে।
কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট ড. বিয়র্ন লোমবোর্গ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্বের দ্রুত-বর্ধনশীল মেগাসিটিগুলোর মধ্যে অন্যতম, কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি ঢাকার জন্য অস্বাভাবিক যানবাহন সম্পর্কিত ট্রাফিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।’
পরিবহন পরিকল্পনাবিদ রবার্ট গালার তাঁর গবেষণায় ঢাকার ভবিষ্যৎ শহুরে পরিবহন ব্যবস্থার জন্য বিকল্প পদ্ধতির বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে জনাকীর্ণ বড় শহর এবং তীব্র পরিবহন সমস্যার সম্মুখীন। গণপরিবহনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান এবং ঢাকার বাস ব্যবস্থার উন্নতিসাধন এই শহরের যানজট মোকাবিলায় কম খরচে বর্ধিত ধারণক্ষমতা প্রদানের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে।’
ঢাকার বর্তমান যানজটের পেছনে দুটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো, পরিকল্পনা ও পূর্ববর্তী দশকগুলোতে নেওয়া প্রস্তুতির অভাব এবং সরকারি বাস ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে ব্যক্তিগত পরিবহনের ওপর অতি-নির্ভরতা।
বর্তমানে, ঢাকার যানবাহনের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ৬.৪ কিমি। কিন্তু গাড়ির পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে তাহলে গণপরিবহনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিনিয়োগ ছাড়াই ২০৩৫ সাল নাগাদ গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ৪.৭ কিলোমিটারে নেমে আসতে পারে। যা প্রায় হেঁটে যাওয়ার মতো ধীরগতি।
২০১৪-১৫ সালে সরকার একটি রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) অনুমোদন করে। যেখানে পাঁচটি পাতাল রেল লাইন, দুটি দ্রুতগতির বাস রুট এবং এক হাজার ২০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। যা বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্কের দ্বিগুণ এবং যাতে ৬টি উত্থিত এক্সপ্রেসওয়ে এবং ৩টি রিং রোড অন্তর্ভুক্ত আছে। আগামী ২০ বছরে, এই প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় সরকারের মোট ব্যয় হবে প্রায় তিন লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা।
‘বাংলাদেশের অগ্রাধিকার’ গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রস্তাবিত সরকারি খরচের তুলনায় পরবর্তী দুই দশকে ঢাকার পরিবহন খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক বেশি পরিমাণে হবে। সব ব্যক্তিগত পরিচালনা ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে যেমন জ্বালানি, চালকের বেতন, গ্যারেজে রাখা, সাথে নতুন গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশার প্রকৃত ক্রয় খরচ ধরে, ব্যক্তিগত খরচ হতে পারে প্রায় ছয় লাখ আট হাজার ৪০০ কোটি টাকা অথবা সরকারি খরচের দ্বিগুণ।
রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের (আরএসটিপি) প্রস্তাবিত সরকারি খরচ ঢাকার যানবাহনের গতিপ্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করবে, রাস্তার ধারণক্ষমতা এবং মেট্রো রেল উভয়ের বৃদ্ধির দিক থেকেই। পরিকল্পনায় দেখা যায় যে এটি ঢাকার যানবাহনের গতিকে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৩.৭ কিমি পর্যন্ত বাড়াতে পারে – যে গতি ২০১০ সালের দিকে শেষ দেখা গিয়েছিল। যাতায়াতের ক্ষেত্রে সময় সাশ্রয়ের দিক থেকে লাভের সবচেয়ে বড় অংশটি আসতে পারে। সামগ্রিকভাবে, বিশ্লেষণটিতে দেখা যায় যে ‘কিছুই না করা’ অবস্থার তুলনায় আরএসটিপির অধীনে ব্যয়িত প্রতি টাকার ক্ষেত্রে প্রায় তিন টাকার সমপরিমাণ কল্যাণ সাধন করবে।
গালার একটি বিকল্প পরিস্থিতি পরীক্ষা করে দেখেছেন যা বাস ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোতে বৃহত্তর বিনিয়োগের ওপর দৃষ্টিপাত করে এবং একইসাথে জায়গা-দখলকারী বহুসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, সাইকেল এবং রিকশার প্রয়োজনকে প্রশমিত করবে। পরিস্থিতি থেকে অনুমান করা যায় যে পরিবহন পরিকল্পনা খসড়ার আওতায় একই পরিমাণ সরকারি খরচে আরো অতিরিক্ত ৯ হাজার বাস পাওয়া যাবে। এর ফলাফল হবে ২০৩৫ সাল নাগাদ এক লাখ অতিরিক্ত গাড়ি, যা আরএসটিপির কৌশল অনুযায়ী অনুমিত সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ কম। বিকল্প উপায়টি তুলনামূলকভাবে অনেক কম রাস্তা দখল করবে, যানজট কমাবে এবং যানবাহনের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ১৪.৪ কিলোমিটারে নামিয়ে আনবে, যাত্রীদের আরো বেশি সময় সাশ্রয় করার মাধ্যমে।
বিকল্প পরিস্থিতি যানবাহন, চালক, খুচরা যন্ত্রাংশ এবং জ্বালানির ওপর করা বেসরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে রক্ষা করবে। আগামী ২০ বছরে, বেশি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বাসগুলো অনেক বেশি পরিবহন ক্ষমতা প্রদান করতে পারে, আরএসটিপির পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যক্তিগত যানবাহনে বিনিয়োগের প্রায় এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা রক্ষা করার পাশাপাশি – ১৫ শতাংশ খরচ হ্রাস হবে। যা সাড়ে চারটি পদ্মা সেতু তৈরির খরচের সমান।
যানজট হ্রাস এবং পরিবহন ব্যবস্থায় খরচ কমিয়ে আনার সম্মিলিত সুবিধার অর্থ হলো ব্যয়িত প্রতি টাকা প্রায় ৬ টাকার সমপরিমাণ কল্যাণ সাধন করবে।