সুনামগঞ্জে কৃষকের মাথায় হাত
সুনামগঞ্জের আট উপজেলার বেশ কয়েকটি হাওরের বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে তলিয়ে গেছে কৃষকের একমাত্র ফসল বোরো ধান। সেই সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতেও ক্ষতি হয়েছে ধানের। জলাবদ্ধতার কারণে বোরো ফসলের দুই-তৃতীয়াংশই এখন পানির নিচে।
অনেক কৃষক তলিয়ে থাকা ক্ষেত থেকে আধা পাকা ধান কেটে তুলছেন। অনেকে ওই ফসল কাটার পর কতটুকু ধান পাবেন তা নিয়ে আশঙ্কায় আছেন। সব মিলিয়ে ফসল থেকে লাভ তো দূরের কথা, খরচের টাকা তুলতে পারবেন কি না, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষকরা। এ যেন তাদের মাথায় হাত!
এদিকে প্রশাসন ও কৃষকরা এ নিয়ে বাঁধের কাজ শেষ না করায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের গাফিলতিকেই দায়ী করছেন।
হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলা বছরের বেশির ভাগ সময় পানির নিচে থাকে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে পানি কমলে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। এ বছর সারা জেলায় দুই লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ফসল চাষাবাদ করা হয়। এই একটি মাত্র ফসল দিয়েই চলে সারা বছর। এ বছর কৃষকরা যখন বাম্পার ফলনের আশায় পাকা ধান কাটার চিন্তা করছেন ঠিক সেই সময় আগাম শিলাবৃষ্টিতে হাওরের পানি ঢুকে কয়েক হাজার হেক্টর বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে যায়।
একইসঙ্গে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওর, মইয়ার হাওর, তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ানা হাওর, শনির হাওর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওর, আঙ্গুরগুলি হাওর ও সদর উপজেলার কানলার হাওর, বাউনেরপাড় ছাড়াও শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলার বেশ কিছু হাওরের বেড়িবাঁধ ভেঙে হাওরের ফসলি জমির অধিকাংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকরা দ্রুত যে ধান কেটে ঘরে তুলতে চাইছেন তাও আধাপাকা। এ নিয়ে বেশ হতাশায় আছেন হাওরপারের কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, আগাম বৃষ্টি ও বেড়িবাঁধ নির্মাণে পাউবোর অনিয়মের কারণেই বোরো ধান এখন পানির নিচে। আর যে ধানগুলো হাওরে আছে সেগুলোও ঘরে তুলতে পারবেন কি না এ নিয়ে বেশ উদ্বেগে আছেন কৃষকরা।
এক সপ্তাহ ধরে টানা বৃষ্টিপাত ও বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে জগন্নাথপুরের মইয়ার হাওর, তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শিমুলবাঁক, দরগাপাশা, পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের ছোট ছোট বেশ কিছু হাওর, বিশ্বম্ভরপুর ও সদর উপজেলার করচা হাওর, সদর উপজেলার জোয়ালভাঙ্গা ও কানলার হাওর, জামালগঞ্জের বেহেলী হাওর, শাল্লার বাহাড়া ইউনিয়নের খলি, মুনয়া ও রূপসা গ্রামের কাছের হাওরের ফসলি জমি। অনেক হাওরের জমির অধিকাংশ আবার কিছু হাওরের জমি আংশিক পানিতে তলিয়ে গেছে।
শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সদর উপজেলার করচা, দেখা হাওর, তাহিরপুর উপজেলার শনি হাওর, মাটিয়ান হাওর, মহালিয়া হাওর , জামালগঞ্জের বৃহত্তর পাগনা, হালি হাওর, গজারিয়া হাওর ও ছনুয়ার হাওর।
জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওর, চিলাউড়া হাওর, মইয়ার হাওর, কেওলার হাওর, বাঘ ময়নার হাওর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দেখা হাওর শিলা বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শাল্লা উপজেলা শাসখাইর হাওর, বরাম হাওর ও বাহারা ইউনিয়নে পুড়ারপার হাওর শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বৃষ্টির পানিতে অধিকাংশ হাওরের নিচু জমি তলিয়ে যাচ্ছে।
দিরাই উপজেলার কালিকুটা হাওর, বরাম হাওর, উদগল হাওর, নারাইনকুরী হাওরের জমির ফসল শিলা বৃষ্টিতে এবং জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দিরাই উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রনধীর চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলার বিভিন্ন হাওরে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমির ফসল শিলাবৃষ্টিতে এবং ৩০০ হেক্টর জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ১০০ একর জমি তলিয়ে গেছে। শিলাবৃষ্টিতে উপজেলার বৃহৎ দুটি হাওর শনি ও মাটিয়ানে পাকা ধানের কিছু ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।’
ক্ষতির কথা বললেন জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদির আহমদ মুক্তা। তিনি বলেন, ‘শিলাবৃষ্টিতে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক এলাকায় কৃষকরা জমিতেই যাচ্ছেন না। ধান গাছে একটি ধানও নেই, সব ধান জমিতে পড়ে গেছে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, ‘টানা বৃষ্টিপাতে কয়েকটি উপজেলার হাওর জলাবদ্ধতার পানিতে তলিয়ে আবার কোথাও বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙে তলিয়েছে তিন-চারটি হাওর এবং শিলাবৃষ্টিতে ১০-১৫টি হাওরের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরুপণ করতে আরো কিছু সময় লাগবে। আবহাওয়া অনূকুলে এলে ক্ষতির পরিমাণ কমতে পারে।’
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জেলার একমাত্র বোরো ফসল রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানান। সেই সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ করেন। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি এবং কাজে অনিয়ম ছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘জেলার একমাত্র ফসল হওয়ায় আমরা এখন আতঙ্কের মধ্যে আছি।’
এদিকে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, ‘সদর উপজেলার সবচেয়ে বড় খরচার হাওর। এ হাওরের ধান দিয়ে উপজেলা চলে। এখানে পানি বেশি। এখন সেখানে মেশিন বসিয়ে পানি কমানোর চেষ্টা চলছে।’
আর যাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ সেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও দেখা করা যায়নি। এমনকি তিনি মোবাইল ফোনও ধরেননি।
জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে সুনামগঞ্জের কোনো বাঁধ তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়। দিরাইয়ের তুফানখালীতে একটি বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে আজ তার সংস্কার করা হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে পানি কমছে খুবই ধীরগতিতে। এখন নতুন করে বৃষ্টি শুরু হলে সমস্যা বেড়ে যাবে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া আছে।’