বেনামি পত্রও অভিযোগ বলে গণ্য করা যাবে
বেনামী পত্রকেও অভিযোগের কারণ হিসেবে গণ্য করা যাবে—এমন বিধান যুক্ত করা হয়েছে বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধিতে। গতকাল সোমবার রাতে ‘বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা ২০১৭-এর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ‘অভিযোগ, অনুসন্ধান ও বিভাগীয় মামলা রুজু’ সংক্রান্ত ৩ নম্বর বিধির ব্যাখ্যা ১-এ বলা হয়েছে, ‘এই উপবিধির উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, বেনামি পত্রকে সাধারণত অগ্রাহ্য করা হইবে, তবে উহাতে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকিলে এবং অভিযোগের সমর্থনে কাগজপত্র সংযুক্ত থাকিলে বেনামি পত্রকেও অভিযোগের কারণ হিসাবে গণ্য করা যাইবে।’
অভিযোগ, অনুসন্ধান ও বিভাগীয় মামলা রুজুর বিষয়ে এ বিধিতে আরো বলা হয়েছে, সার্ভিসের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে (ক) শারীরিক বা মানসিক অদক্ষতা ব্যতীত, অদক্ষতার সংজ্ঞাভুক্ত অন্য কোনো পরিস্থিতি; (খ) অসদারচরণের সংজ্ঞাভুক্ত কোনো কাজ; (গ) দুর্নীতিমূলক কার্য বা দুর্নীতিতে জড়িত থাকার সংজ্ঞাভুক্ত কোনো কাজ বা পরিস্থিত; (ঘ) রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কার্যের সংজ্ঞাভুক্ত কোনো কাজ বা পরিস্থিতি; (ঙ) সার্ভিস ত্যাগ এর সংজ্ঞাভুক্ত কোনো কাজ; (চ) ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ অভিযোগ।
অনুসন্ধান ও বিভাগীয় মামলা চলাকালে অভিযুক্ত কর্মকর্তার সংযুক্তির বিষয়ে বিধি ৭-এ বলা হয়েছে, ‘সার্ভিসের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বা বিভাগীয় মামলা সূচিত হইলে, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুসারে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ উক্ত সদস্যক তাহার পদ বা প্রেষণ হইতে প্রত্যাহার করিয়া উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অফিসে সংযুক্ত করিতে পারিবে এবং বিভাগীয় মামলার অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করিবে; এবং উক্ত কর্মকর্তা উক্ত অফিস হইতে তাহার প্রাপ্য বেতন ভাতা গ্রহণ করিতে পারিবে।’
১৯৮৯ সালে সরকার বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কিছু পদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করে। এতে অন্য ক্যাডারদের সঙ্গে অসঙ্গতি দেখা দেয়। তৎকালীন সরকার এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য ১৯৯৪ সালের ৮ জানুয়ারি জজ আদালতের বেতন স্কেল বাড়িয়ে দেয়। প্রশাসন ক্যাডারের আপত্তির মুখে সরকার ওই বেতন স্কেল স্থগিত করে।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেনসহ ৪৪১ জন বিচারক ১৯৯৫ সালে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেন।
দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৯৯৭ সালে হাইকোর্ট পাঁচ দফা সুপারিশসহ ওই মামলার রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার ঐতিহাসিক রায়টি দেন।
মাসদার হোসেন মামলার রায় ঘোষণার আট বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয়। ওই সময় যে চারটি বিধিমালা গেজেট আকারে জারি করা হয়েছিল, এর মধ্যে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্ত) বিধিমালা, ২০০৭ একটি। যেখানে বলা হয়েছে, পৃথক বিধি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধান করা হবে ১৯৮৫ সালের গভর্নমেন্ট সার্ভিস রুলস অনুযায়ী।
তবে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ৭ নম্বর নির্দেশনা অনুযায়ী সেই জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের জন্য পৃথক শৃঙ্খলাবিধি এখনো তৈরি হয়নি।
নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন না করায় আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে ১২ ডিসেম্বর তলবও করেন আপিল বিভাগ।
গত বছরের ৭ নভেম্বর বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা ২৪ নভেম্বরের মধ্যে গেজেট আকারে প্রণয়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেওয়া হয়। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।
বেশ কয়েকবার উচ্চ আদালত থেকে সময় নিয়ে সর্বশেষ গতকাল সোমবার সরকার এ বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে। অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের এ বিধিমালা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধের জের ধরেই শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগ করেন।