এবার কুলিয়ারচর থেকে বিদেশে যাচ্ছে কচুরিপানার তৈরি কারুপণ্য
যশোরের ঝিকরগাছার সাঈদ হাফিজ, গাইবান্ধার ফুলছড়ির সুভাষ চন্দ্র বর্মণ, বরিশালের আগৈলঝাড়ার নারীদের পর এবার শোনা গেল কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের জাকির হোসেন, রবিউল্লাহ ও রফিকের মতো বেশ কিছু উদ্যোক্তার নাম। তাঁরা কচুরিপানার ফাইবার দিয়ে তৈরি করছেন কারুপণ্য। দেশ ছুঁয়ে এ সব পণ্য যাচ্ছে এখন বিদেশে। এ কাজের কারিগর অধিকাংশই নারী। ঘরে বসে কাজ করে স্বাবলম্বী তাঁদের অনেকেই। সব মিলিয়ে এক সময়ের ‘আবর্জনা’ কচুরিপানা এখন ভৈরবের কয়েকটি গ্রামে হয়ে উঠছে দামি কাঁচামাল।
জানা যায়, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের কিছু উদ্যোক্তা বছরখানেক আগে ‘সাভার ও গাজীপুর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে’ ফেরেন নিজ গ্রামে। এরপর প্রশিক্ষিত করে তোলেন এলাকার নারীদের। তারপর তৈরি হতে থাকে কচুরিপানার সুদৃশ্য সোনালি কারুপণ্য।
ধীরে ধীরে এ উপজেলায় বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। ছড়িয়ে পড়ে ফরিদপুর, আলীনগর, আলালপুর, আহমদপুর, নলবাইদ, চরপাড়া, নাপিতেরচর, সালুয়া গ্রামে।
এসব অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের দাবি—কচুরিপানার কারুপণ্য এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার ৩০টিরও বেশি দেশে। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
গত এক বছর ধরে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের বহু লোক কচুরিপানার পণ্য তৈরি করে বিক্রির মাধ্যমে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হয়েছেন। উপজেলার নলবাইদ গ্রামের সোহানা, সাদ্দাম ও জীবন মিয়া, ফরিদপুর গ্রামের দেলোয়ারা, নাদিরা ও আরিফ মিয়া, আলীনগর গ্রামের রেহেনা, জাকির হোসেন ও রিক্তা বেগম এবং আহমদপুর গ্রামের সুফিয়া বেগম, আলম মিয়া তাঁদের এলাকায় উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের বিষয় তুলে ধরেন।
উদ্যোক্তা জাকির হোসেন, রবিউল্লাহ ও রফিক মিয়া জানান, এক বছর আগে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সাভার ও গাজীপুর এলাকা থেকে এসব পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে নিজ নিজ গ্রামে এসে ২১দিনব্যাপী কয়েকশ নারীকে প্রশিক্ষিত করে তোলেন। পরে প্রশিক্ষিত নারীদের কাছ থেকে তাঁদের পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশিরা শিখে এই কাজের সঙ্গে জড়ান।
এই উদ্যোক্তারা আরও জানান, কারিগরদের তৈরি তৈজসপত্রগুলো বাড়ি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে শ্রমিক দিয়ে কাটিং করে মসৃন করান। পরে পণ্যগুলোতে বাহারি রং দিয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে কার্টনে ভরে প্যাকেটজাত হয়। এরপর ঢাকা, গাজীপুর, টঙ্গি, উত্তরায় নির্ধারিত অফিসে সরবরাহ করা হয়। সেখান থেকে পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
রপ্তানি করা দেশগুলোতে কচুরিপানায় তৈরি এসব তৈজসপত্রের প্রচুর চাহিদার কথা জানিয়ে উদ্যোক্তারা জানান, এই অঞ্চলে কচুরিপানার কাজের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে, গ্রামের মানুষের অসচ্ছল পরিবারে ফিরছে সচ্ছলতা। তাঁদের দাবি—শিল্পকর্মটি দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে বহুলোকের কর্মসংস্থানসহ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
ফরিদপুর গ্রামের মো. হুমায়ূন কবির, আনন্দ বাজারের মো. সাইফুল ইসলাম, নাপিতেরচর এলাকার মো. খালেদ মিয়া ও উপজেলার উদ্যোক্তারা জানান, নদীমাতৃক বাংলাদেশে কচুরিপানা খুবই সহজলভ্য হওয়ায় অনেকক্ষেত্রে বিনা পয়সার কাঁচামাল হিসেবে গ্রহণ করা যায়। ফলে, উৎপাদন খরচ কম। আবার দেশে ও বিদেশে এর পণ্যের চাহিদা থাকায় সরকারি উদ্যোগ থাকলে এখানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব।
কচুরিপানায় তৈরি হচ্ছে কী কী পণ্য
নদীনালা, খাল-বিল থেকে প্রথমে কচুরিপানা কাটা হয়। পরে পাতা ফেলে কাণ্ড বা ডাটা রোদে শুকানো হয়। সেই শুকানো ডাটা ডিটারজেন পাউডার মেশানো গরম পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। এরপর আবারও ভালোভাবে রোদে শুকানো হয়। তৈরি হয় কচুরিপানার ফাইবার। এরপর ফাইবার টেকসই করতে আরও কিছু কারিশমা করেন উদ্যোক্তারা। পরে সেই ফাইবার দিয়ে বুননে বুননে তৈরি হয় দৃষ্টিনন্দন পণ্য।
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে তৈরি কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে লোহার ফ্রেম দরকার হয়। এসব ফ্রেম ওয়ার্কশপে তৈরি করেন উদ্যোক্তারা। সেই ফ্রেমে কারিগররা কচুরিপানার ফাইবারে শৈল্পিক বুনন দিয়ে তৈরি করেন অবয়ব।
কুলিয়ারচরে যেসব পণ্য তৈরি হয়
বর্তমানে কুলিয়ারচর উপজেলায় তৈরি তৈজসপত্রের মধ্যে রয়েছে—বিভিন্ন আকারের ফল, ফুল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি রাখার ঝুঁড়ি, ফুলের টব, পাপস, কুকুর-বেড়াল, খরগোশ, ঘর, শিশুদের দোলনা, নানা প্রকারের ফুলের ডালি, ফুল ও কলমদানি, ক্যাপ, বসার মোড়া, টি-টেবিল ইত্যাদি।
কারিগরের মজুরি ও পণ্যের দাম
উদ্যোক্তারা ফ্রেম ও কচুরিপানার ফাইবার সরবরাহ করে থাকেন। কারিগররা পণ্যটি তৈরি করেন। পণ্যভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে মজুরি পেয়ে থাকেন তাঁরা। আর পণ্য বিক্রি হয় ৫০০ টাকা পর্যন্ত। অনেকে আবার নিজেই উদ্যোক্তা, নিজেই কারিগর। মধ্যসত্ত্বভোগী না থাকায় তাঁদের লাভের পরিমাণও বেশি।
অনেকের দাবি—এই উপজেলার নারীরা সংসারের কাজের ফাঁকে এবং শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার অবসরে এসব পণ্য তৈরির কাজ করে মাসে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করে থাকেন।
কিশোগঞ্জের আগে ২০১৮ সালে যশোরের ঝিকরগাছার গঙ্গানন্দপুরের জাতীয় পদকপ্রাপ্ত তরুণ উদ্ভাবক সাঈদ হাফিজ কচুরিপানা দিয়ে তৈরি সুদৃশ্য পণ্য তৈরি করে সাড়া ফেলেন। এরও আগে পণ্য তৈরির কথা শোনা না গেলেও কচুরিপানা দিয়ে বরিশালে রঙিন কাগজ তৈরি কথা শোনা যায়। কচুরিপানার হস্তশিল্প তৈরি করে ব্যাপক সমালোচনায় আসেন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনেরপাড়া গ্রামের যুবক সুভাষ চন্দ্র। গত এক বছর ধরে কচুরিপানা নিয়ে কাজ করে এবার আলোচনায় কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম।