দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচনে এএনসির টিকে থাকার লড়াই
১৯৯৪ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকার ও স্বাধীকার অর্জনের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের আবসান ঘটে। নেলসন ম্যান্ডেলা ৩২ বছর কারাভোগের পর ১৯৯৪ সালে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)। সেই থেকে দেশটির ক্ষমতায় দলটি। তবে দীর্ঘ ৩০ বছর পর এএনসি তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য হারাতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। খবর আলজাজিরার।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গত বুধবার সাধারণ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। গতকাল শনিবার (১ জুন) পর্যন্ত ৯৯ শতাংশ ভোট গণনার পর দেখা গেছে, সেখানে ভোট পড়ার হার মাত্র ৫৯ শতাংশ। এর আগে ২০১৯ সালে দেশটিতে ৬৬ শতাংশ ভোট পড়েছিল।
১৯৯৪ সাল থেকে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া এএনসি অন্যান্য দলগুলোর সাথে জোট করতে ভোটের পুরো ফলাফল আসার আগেই আলোচনা শুরু করেছে যা আগে কখনো করতে হয়নি তাদের। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা জোট সরকার গঠন করলে শরিকদের পক্ষ থেকে যে চাপের মুখোমুখি হবে তা এএনসির ভবিষ্যত পরিকল্পনার উপর মেঘের ছায়া তৈরি করবে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে এএনসি প্রায় ৪০ শতাংশ, প্রধান বিরোধী দল গণতান্ত্রিক জোট ২১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার উমখন্তো উই সিজওয়ে (এমকে) পার্টি। ধারণা করা হচ্ছে, এমকে পার্টি এএনসির ভিত্তি ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা কোয়াজুলু নাটাল প্রদেশে সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া রামফোসার অধীনে এএনসি পরবর্তী সরকার গঠন করবে কিনা তা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এমকে পার্টি জাতীয় ভোটের প্রায় ১৫ শতাংশ এবং জ্যাকব জুমার নিজ প্রদেশ কোয়াজুলু নাটালে ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার মোট ভোটার রয়েছে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৭২ হাজার ২৬৪ জন। ভোট পড়েছে ৫৮.৬০ শতাংশ। কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০০৯ সালের পর থেকে ভোটদানের হার কমতে দেখা গেছে।
এমকে পার্টি সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাসহ এএনসির অনেক সাবেক রাজনীতিবিদদের নিয়ে গঠিত, তারা প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত এএনসির সঙ্গে কোনো অলোচনায় বসবে না বলে জানিয়েছে।
কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট ফর সাসটেইনেবিলিটি লিডারশিপের আফ্রিকা বিষয়ক পরিচালক রিচার্ড ক্যালান্ড বলেন, এএনসি এ নির্বাচনে বাজেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তবু এএনসি দক্ষিণ আফ্রিকার বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং তাদের ছাড়া পরবর্তী সরকার গঠন করা প্রায় অসম্ভব। তাই জোট সরকার গঠন করতে হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রামফোসা জোট সরকার গঠন করতে আগ্রহী কিনা, না তিনি পদত্যাগ করবেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে ২০১৪ সালে সিরিল রামাফোসাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন। দুজনের মধ্যে মতবিরোধ ও একাধিক দুর্নীতির কেলেঙ্কারির অভিযোগ এনে জ্যাকব জুমা ২০১৮ সালে দলীয় নেতৃত্ব এবং প্রেসিডন্টে পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। জুমার স্থলাভিষিক্ত হয়ে রামাফোসা এএনসির নেতা ও সভাপতি হন। তারপর রামাফোসা জুমার দুর্নীতির তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জুমাকে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অপচয়ের জন্য দায়ী হিসেবে উল্লেখ করেন।
রামাফোসা আফ্রিকান ইউনিয়নের সাবেক নেতা ও নেলসন ম্যান্ডেলার অনুগামী হওয়ার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ২০২৪ সালে নিবাচনি জরিপে তিনি এএনসির সবচেয়ে নামকরা নেতা ছিলেন। ফিলিস্তিনিদের সমর্থন এবং গাজার যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক গণহত্যার মামলা তোলার জন্য রামাফোসা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশেষভাবে প্রশংসা র্অজন করেন।
কিন্তু র্বতমান পরিস্থিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, এমকের পরিবর্তে ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (ডিএ) সঙ্গে জোট করলে তা এএনসি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা উভয়ের জন্যই অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। সমালোচকরা মনে করেন, ডিএর সঙ্গে জোট গঠন করলে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের স্বার্থ হাসিল হবে। ডিএ জোট এএনসি ও রামাফোসার কট্টর সমালোচক। নির্বাচনের আগে তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে এএনসি হাত থেকে উদ্ধার করা। যার ফলে রামাফোসার জন্য জোট সরকার গঠন করা কঠিন পরীক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।