কেন স্বামী-সন্তানসহ মুখে টেপ লাগিয়ে ঘুমান এই নারী?
অপহরণ, বন্দিদশা বা এ ধরনের পরিস্থিতিতে যখন জোরপূর্বক কারো মুখ টেপ দিয়ে আটকে দেয় দুর্বৃত্তরা, সে রীতিমতো এক নির্যাতন। কিন্তু স্বেচ্ছায় কেউ এমন দশা বরণ করতে পারে, এমনটা কি বিশ্বাস করা সম্ভব নাকি সেটা ভাবা যায়? অথচ দিনের পর দিন এমন কাণ্ড করে চলেছেন ইন্দোনেশিয়ার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আন্দিয়েন।
বিবিসির এক প্রতিবেদন জানায়, আন্দিয়েন ঘুমের সময় মুখে টেপ লাগিয়ে ঘুমান। এ কাজ যে শুধু তিনি একাই করেন, তা কিন্তু নয়। তাঁর স্বামী আর দুই বছর বয়সী পুত্রকেও একই তরিকায় ঘুমাতে হয়!
শুনতে আজব মনে হলেও বাস্তবে এটাই ঘটছে, আর এর পেছনের কারণও ব্যাখ্যা করেছেন সুন্দরী আন্দিয়েন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে মুখে টেপ লাগানো স্বামী, সন্তান ও নিজের ছবি পোস্ট করে ভক্তদের রীতিমতো ভিরমি খাইয়ে আন্দিয়েন লেখেন, ‘এটা আপনার কাছে উদ্ভট মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা এমন অনেক বিষয়েই জ্ঞান অর্জন করি, যা বাস্তবে কখনো প্রয়োগ করা হয় না। আবার যা প্রতিনিয়ত করতে হয়, এমন অনেক বিষয়েরই আমরা কোনো খোঁজখবর রাখি না। যেমন ধরুন শ্বাসপ্রশ্বাস।’
এর পরপরই গায়িকা আরো বিস্তারিত বর্ণনায় জানান, গত তিন মাস ধরে তিনি ও তাঁর পরিবার মুখে টেপ লাগিয়ে ঘুমানোর এ ব্যাপারটি চর্চা করছেন। এটি শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি। এর নাম— ‘বুতেইকা’ বা ‘বিউটিকো’। বুতেইকোর মাধ্যমে ঘুমের সময় কেবল নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে মানুষকে অভ্যস্ত করা হয়।
আন্দিয়েন জানান, বুতেইকো চর্চা করে এরই মধ্যে তিনি অনেক উপকার পেয়েছেন। তাঁর ঘুম এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়। এ ছাড়া ঘুমের মধ্যে গলা শুকিয়ে আসা এবং নিশ্বাসে কোনো রকমের দুর্গন্ধ থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন।
কিন্তু আন্দিয়েনের পোস্ট দেখে অনেকেই হায় হায় করে উঠেছেন। প্রশ্ন করছেন, আসলেই কি বুতেইকোতে কাজ হয়? এটা কি আদৌ নিরাপদ?
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, ১৯৫০ সালে সর্বপ্রথম সোভিয়েত চিকিৎসক কনস্টানটিন পাভলোভিচ বুতেইকো বিশেষ করে অ্যাজমার চিকিৎসায় শ্বাসপ্রশ্বাসভিত্তিক এ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। তাঁর নামেই এটির নামকরণ করা হয়।
আন্তর্জাতিক বুতেইকো ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিক ম্যাককেউন জানান, ঘুমের সমস্যা—বিশেষ করে অ্যাপনিয়া, যাতে ঘুমের সময় মানুষের শ্বাসনালিতে নিশ্বাস আটকে যায় ও ঘুমের সমস্যা হয়, নাক ডাকা তৈরি হয়—এসব সমস্যায় বুতেইকো কার্যকর।
কিন্তু এ পদ্ধতির ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন অন্য চিকিৎসকরা। মিশিগানের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ক্যাথলিন ইয়ারেমচাক বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি কেবল নাক দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে পারছেন কি না, সেটা আগে দেখতে হবে। বেশিরভাগ মানুষই নাক দিয়ে শ্বাসকার্য চালাতে অসুবিধা না হলে, নিজ থেকে কখনো মুখ খোলে না। মুখ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর মানে হলো, তাদের নাকে সমস্যা আছে।’
এ রকম ক্ষেত্রে মুখ বন্ধ রাখলেই নাকের সমস্যা দূর হবে না বলে জানান এ চিকিৎসক।
নাক-কান-গলা বিষয়ক ব্রিটিশ মেডিকেল সংস্থা ইএনটির সভাপতি নির্মল কুমার বলেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রে বুতেইকো পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্বন্ধে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো প্রমাণ বা তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে শুধু বুতেইকো নয়, শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের অন্য যেকোনো পদ্ধতিই অ্যাজমা ও শ্বাসনালি-সংক্রান্ত জটিলতার জন্য বিভিন্ন মাত্রায় উপকারী। ফলে স্বাভাবিকভাবে কেউ বুতেইকো করে উপকার পেতেই পারেন। কিন্তু এটি বুতেইকোর কৃতিত্ব নয়।’
দুই চিকিৎসকই টেপ দিয়ে মুখ আটকে এভাবে ঘুমানো বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করেন।
তবে বুতেইকো ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাককেউন জানান, কেউ যদি অসুস্থ হয়, আর তার বমি করার দরকার পড়ে, তখন কিন্তু মুখে টেপ লাগিয়ে রাখলে তা করা সম্ভব হবে না। এতে করে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
শিশুদের ক্ষেত্রে বুতেইকো পদ্ধতি ব্যবহার না করার ব্যাপারে আরো বেশি করে সতর্ক করেন এ চিকিৎসক।
নির্মল কুমার বলেন, ‘কেবল নাক দিয়ে শ্বাসকাজ চালানো শিশুর জন্য অনেক কঠিন। এতে করে সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। এ থেকে শিশুর মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।’
এ ছাড়া সমস্যা বোধ করলে বড়রা হয়তো ঘুম ভেঙে নিজের মুখ থেকে টেপ খুলে ফেলতে পারবে, কিন্তু শিশুরা তা পারবে না। আবার এমন অনেক সমস্যাও থাকে শিশুদের, যেসব ক্ষেত্রে তাদের মুখ দিয়েই কেবল শ্বাসকার্য চলে। এমন শিশুদের ক্ষেত্রে বুতেইকো পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে, তারা মারাও যেতে পারে।