সন্তানদের নাম দিয়ে জাতিপ্রথার প্রতিবাদ!
ভারতের নদীকুড়ার একটি ছোট্ট রেলস্টেশন। নির্ধারিত কমিউটার ট্রেনটি স্টেশনে প্রবেশের আগেই প্ল্যাটফর্মে এসে ঢোকে দ্রুতগতির এক্সপ্রেস ট্রেন। ঠিক এই সময় রেলওয়ের এক কর্মকর্তা হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘অ্যাই স্পেসশিপ (মহাকাশ যান), এদিকে এসো...’!
প্ল্যাটফর্মে থাকা যাত্রীরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, সত্যিই স্পেসশিপ দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওই রেল কর্মকর্তার দিকে। তবে এই স্পেসশিপ মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার কোনো অতিকায় যান নয়। এই স্পেসশিপ দুপায়ের এক প্রাণী। যিনি আপনার-আমার মতোই একজন মানুষ।
৪৩ বছর বয়সী স্পেসশিপের বাবা ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা ক্রোসুরি ভীরা রাঘবা। ভারতের সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত জাতিভেদপ্রথাকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। আর এর শুরুটা করেছিলেন নিজের ঘর থেকে। তাই নিজের সন্তানদের নাম রাখার জন্য তিনি বেছে নেন অদ্ভুত এক পদ্ধতি। সন্তানদের নাম রাখতে সহায়তা নেন মহাকাশ বিজ্ঞানের।
কমিউনিস্ট এই নেতার পাঁচ সন্তান। ছেলেদের নাম যথাক্রমে স্পেসশিপ, ফিউশন, স্পেস শাটল ও শাটল চ্যালেঞ্জার। একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছেন ভাইকিং টু।
টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, স্থানীয় রেলস্টেশনের ক্যান্টিনে সহকারী হিসেবে কাজ করেন স্পেসশিপ। নিজেদের নামের বিষয়ে স্পেসশিপ বলেন, ‘কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে আমার বাবা চাইতেন যে, আমাদের ভাইবোনদের নাম শুনে যেন সমাজে বা স্কুলে আমাদের জাতিবর্ণ বোঝা না যায়।’
১৯৬৬ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠায় সুয়েজ নামে একটি স্পেসশিপ বা মহাকাশযান। এর এক বছর পর জন্ম নেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের শুভাকাঙ্ক্ষী ও কমিউনিস্ট নেতা ভীরা রাঘবার বড় ছেলে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন ছেলের নাম রাখবেন সুয়েজ। কিন্তু এই নামের অর্থ স্থানীয়দের কাছে বোধগম্য করতে স্পেসশিপ নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
জাতিবর্ণপ্রথার ঘোর বিরোধী ভীরা রাঘবা বিয়ে করেন মারিয়াম্মা বান্ডলা নামের একজন দলিত নারীকে। নিজেদের সব সন্তানের নামের উপাধি হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে তাদের মায়ের বান্ডলা উপাধি যোগ করেন ভীরা। নিম্ন সহকারী হিসেবে ১৯৯৪ সালে চাকরি থেকে অবসরে যান তিনি। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে মারা যান ভীরা।
কমিউনিস্ট এই নেতার সন্তানদের এখন বেঁচে থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু তবু নিজেদের পিতৃপরিচয়ে গর্বিত তাঁরা। ভীরার একমাত্র মেয়ে ভাইকিং টু এখন দিনমজুরি করেন। তাঁর আরেক ছেলে শাটল চ্যালেঞ্জার ট্রেনে চা বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা বেঁচে থাকতে সে সময়কার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ব্রহ্মানন্দা রেড্ডি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। যখনই তিনি আমাদের শহর সফরে আসতেন, তখনই আমাদের বাড়িতে এসে বাবার সঙ্গে এক কাপ চা পান করে যেতেন। কিন্তু আমার বাবা মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো দিন সামান্য কোনো সুবিধাও নেননি।’
ভীরা রাঘবা ছিলেন একজন সত্যিকারের কমিউনিস্ট নেতা। তাঁর একসময়ের সহযোগী আনজানেয়লু বলেন, ‘ভীরা সব সময় বলতেন, একজন সত্যিকারের কমিউনিস্ট কখনো কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখার ভেতরে চিন্তা করে না। সে চিন্তা করে বৈশ্বিকভাবে। আর তাই ভীরা তাঁর মেয়ের নাম রেখেছিলেন ভাইকিং টু। ১৯৭৬ সালে নাসা থেকে মঙ্গলের উদ্দেশে পাঠানো এক মহাকাশ যানের নামে।
শুধু কি ছেলেমেয়েদের নাম? দুই নাতির নামও রেখেছেন ভীরা। এদের একজনের নাম কাসার আর আরেকজনের নাম সাগান। ভীরার নাতি কাসার এখন প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ছেন। তিনি বললেন, ‘ছোটবেলায় স্কুলে সবাই আমার নাম নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করত। এমনকি আমার পরিবারের সবার নাম নিয়েও আশপাশের মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল না। কিন্তু এখন আমি আমার নাম নিয়ে গর্ব বোধ করি। আমি জানি কাসার হচ্ছে সেই পদার্থ যা ছায়াপথে থাকে, এটি উজ্জ্বল এবং শক্তিতে পরিপূর্ণ।’