কী আছে নেতাজিকে নিয়ে প্রকাশিত নথিতে
পূর্বঘোষণার পর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে সম্পর্কিত গোপন নথিগুলো প্রকাশ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার। আজ শুক্রবার রাজ্য সরকারের হেফাজতে থাকা ৬৪টি গোপন নথি ডিজিটাল ভার্সনে ডিভিডি আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ১২ হাজার ৭৪৪ পাতার এই গোপন নথি জনগণের জন্য প্রকাশ করা হলো। এই ৬৪টি নথির পাশাপাশি প্রকাশ্যে আনা হয়েছে নেতাজির লেখা বেশ কিছু চিঠিও। নথিগুলো আপাতত কলকাতার পুলিশ জাদুঘরের আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকবে। পরে এগুলো এপিসি রায় রোডে পুলিশ জাদুঘরে স্থানান্তর করা হবে।
আজ স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় কলকাতা পুলিশ মিউজিয়ামে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত এই নথিগুলো প্রকাশ করেন নগরপাল সুরজিত কর পুরকায়স্থ। পরে তিনি এ-সংক্রান্ত ডিভিডি তুলে দেন নেতাজি পরিবারের সদস্য কৃষ্ণা বসুর হাতে। পুলিশে সদর দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, আগামী সোমবার থেকে ছুটির দিন বাদে এই নথিগুলো দেখতে পাবেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে নেতাজি সুভাষ বসুর অন্তর্ধান সংক্রান্ত ৬৪টি নথি প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জোর জল্পনা শুরু হয়েছে তাহলে কি এবার ফাঁস হবে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য? ভারতের গুমনামি বাবা কিংবা শৌলমারির সাধুই কি ছদ্মবেশী নেতাজি ছিলেন?
এ ছাড়া নেতাজির অন্তর্ধান সংক্রান্ত রহস্যও সমাধান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জাপানের তাইহোকুতে (বর্তমান তাইওয়ান) বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি বলে এর আগে জানিয়েছিল নেতাজির অন্তর্ধান সংক্রান্ত বিতর্কের সমাধানে গঠিত মুখার্জি কমিশন। তাহলে তিনি কোথায় গেলেন? কী হয়েছিল তাঁর? তবে প্রকাশিত এই ৬৪টি ফাইলে নেতাজির বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
প্রকাশিত নথিগুলো মূলত ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের। তবে নেতাজি গবেষকদের দাবি, নেতাজি সংক্রান্ত তথ্য সেই অর্থে নেই পশ্চিমবঙ্গের এই নথিগুলোতে। এই সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য রয়েছে দিল্লির মহাফেজখানায়।
শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেফাজতে থাকা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত নথিগুলোগুলো প্রকাশ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানান বসু পরিবার। নেতাজি পরিবারের সদস্য কৃষ্ণা বসু বলেন, নেতাজি সংক্রান্ত গোপন নথিগুলো প্রকাশ করা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দৃঢ় পদক্ষেপ। তবে কেন্দ্রের কাছে নেতাজি সংক্রান্ত আরো যে ১৫০টি নথি আছে তা প্রকাশ করা উচিত বলেও দাবি করেন তিনি।
নথি প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তিনি বলেন, ‘আমরা কথা দিয়েছিলাম নেতাজির নথি প্রকাশ্যে আনব, আমরা আমাদের সেই কথা রেখেছি। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা নেতাজির জন্মদিন জানি, কিন্তু তাঁর মৃত্যুদিনটি জানি না।’
প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নথিগুলোতে ১৯৩৮ সাল থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ির ওপর ব্রিটিশ সরকারের পর কারা নজর রাখতেন সেই সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া সেই সময়ে নেতাজির বাড়িতে কারা আসতেন, কারা যেতেন সেই বিষয়ের তথ্য আছে।
নথিগুলো থেকে জানা যাবে, কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হওয়ার পর নেতাজির ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের নেপথ্য কাহিনীও। কীভাবে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন নেতাজি তার প্রেক্ষাপটের তথ্য রয়েছে এই সমস্ত গোপন ফাইলে। নেতাজিকে উদ্দেশ্য করে তাঁর স্ত্রীর লেখা ব্যক্তিগত চিঠিও রয়েছে এই ফাইলে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে সুভাষ বসুর অন্তর্ধান সংক্রান্ত নথিগুলো প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে ফের জল্পনা জোরদার হতে আরম্ভ করেছে। নেতাজি গবেষকদের অনেকেরই দাবি, কলকাতায় এখনো নেতাজি সংক্রান্ত ৭০টি নথি গোপনে রাখা আছে। যে রহস্য প্রকাশ্যে এলে দেশের তথা পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা দায় হয়ে যাবে।
নেতাজি গবেষক অনুজ ধর এনটিভি অনলাইনের কাছে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর সবার জানা উচিত বলে দাবি করেন। প্রশ্নগুলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের কাছ থেকে নেতাজির নথিগুলো প্রকাশের দাবি নিয়ে কেন চাপ সৃষ্টি করছেন না? জাপানের রেনকোজি মন্দিরে চিতাভস্ম কার? একটা মৃত্যু অথচ তিনটে কমিশন কেন? ১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কি নেতাজির নথিগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়? নেতাজি মৃত, এ কথা কি সত্যিই মানত না ব্রিটিশ ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা? রাশিয়ার গোয়েন্দা আর্কাইভ থেকে কি উবে গিয়েছিল নেতাজি নথিগুলো? কোথায় গেল আজাদ হিন্দ সরকারের টাকা পয়সা, গয়নাগাটি? নেতাজি কোথায় জানতেন বলেই কি মরতে হলো লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে? নেতাজি রহস্য চেপে রাখতেই কি শাহরিয়ারের মুক্তি?
এ ছাড়া নেতাজি গবেষক অনুজ ধরের দাবি, নেতাজি রাশিয়ায় সে কথা জানতেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, বল্লবভাই প্যাটেল সবাই। ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান সংক্রান্ত ৬৪টি নথি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ফের নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নতুন মাত্রা পেল। এখন দেখার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রকাশিত ৬৪টি ফাইলের হাত ধরে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক সমীকরণে কোনো দোলা জাগায় কি না!