ফেয়ারনেস ক্রিম মানসিক অসুস্থতা বাড়ায়
ত্বক ফর্সা করতে বা আরো উজ্জ্বলতার জন্য নারী-পুরুষ উভয়েই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করে। টিভি খুললেই বিজ্ঞাপনের বাহার দেখা যায়। ওইসব বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেন বিশ্বের নামিদামি মডেলরা। বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে মানুষ কিনতে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু এক গবেষণা বলছে, ফেয়ারনেস ক্রিমের ব্যবহার মানসিক অসুস্থতা তৈরি করে।
ভারতের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্স (টিআইএসএস) সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নাল পাবলিক হেলথে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ফেয়ারনেস ক্রিম মানসিক অসুস্থতা বাড়ায়। পরিবার ও সমবয়সীদের চাপের কারণে নারী-পুরুষ উভয়েই অল্প বয়স থেকে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার শুরু করে। ফর্সা ত্বককে বিবেচনা করা হয় উন্নত ক্যারিয়ার সহায়ক, বৈবাহিক ও সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে। খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মিড ডের।
২১ বছরের পারুল শর্মা (ছদ্মনাম), যিনি মুম্বাইয়ের একটি নামকরা কলেজে ইংরেজিতে স্নাতক পড়ছেন। তিনি প্রথমবারের মতো ত্বক নিয়ে দ্বিধায় পড়েন, যখন তাঁর বয়ফ্রেন্ড তাঁকে ছেড়ে যান। কারণ তাঁর ত্বক নাকি খুব কালো। অতিরিক্ত ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহারের পর তাঁর ত্বকে ইনফেকশন হয়, এতে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি এখন ডিসমরফোফোবিয়ায় ভুগছেন। ঘর থেকে বের হতে মন সায় দেয় না, এমনকি কলেজে যেতেও। শারীরিক ‘খুঁত’ নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন তিনি।
সম্প্রতি, এক হাজার ৯৯২ জনের ওপর জরিপ চালানোর পর একটি গবেষণাপত্র তৈরি করা হয়, যেখানে দেখানো হয় কীভাবে কসমোপলিটন শহর মুম্বাইয়ে ফর্সা ত্বকের ধারণা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।
টিআইএসএসের সেন্টার অব হেলথ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসের ড. হেমাল শ্রফ এ গবেষণা প্রকল্পটি পরিচালনা করেন। এতে মুম্বাইয়ের ১,২৩৮ জন নারী ও ৭৪৬ জন পুরুষ অংশ নেয়, যাদের ৬৩ শতাংশের বয়সসীমা ১৮ থেকে ২৪। এদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ নারী এবং ৪৬ দশমিকি ২ শতাংশ পুরুষ ফেয়ারনেস পণ্য ব্যবহার করেছে।
ড. শ্রফ বলেন, ‘অতিরিক্ত ফেয়ারনেস পণ্য ব্যবহার শুধু পাবলিক হেলথ ইস্যু হিসেবেই বিবেচিত নয়, এটা জাতিগত ও সামাজিক অসাম্যও বাড়িয়ে দেয়।’
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩১ দশমিক ২ শতাংশ ত্বক ফর্সাকারী পণ্য ব্যবহার করে, যাতে সুন্দর দেখায়। ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ ব্যবহার করে, যাতে দেখতে উজ্জ্বলতর দেখায়; এটাও মনে করে তা সংস্কৃতিগতভাবে গ্রহণীয়।
গত বছর বলিউড তারকা কঙ্গনা রানাউত ফেয়ারনেস পণ্য প্রচারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। অভিনেতাদের এ ধরনের প্রচারণাকে লজ্জাজনক বলেও অভিহিত করেন। শ্রফের গবেষণা কঙ্গনার উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। গবেষণাপত্র মতে, ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ত্বক ফর্সাকারী পণ্য ব্যবহার করেছেন। শ্রফ বলেন, ‘উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ, বেশিরভাগ তরুণ বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রভাবিত হয়, বিশেষ করে সেলিব্রেটিদের দ্বারা।’
তামাটে ত্বকের অধিকারীরা পারিবারিক চাপে থাকে। ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ মেয়ে ও ৩৩ দশমিক ৪ শতাংশ ছেলে অংশগ্রহণকারী জানায়, তাদের পরিবার ও সমবয়সীরা উজ্জ্বল ত্বকের ধারণা পোষণ করত।
অংশগ্রহণকারীদের ১৭ শতাংশই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভুগেছে। যেসব ফেয়ারনেস পণ্যে হাইড্রোকুইনান, স্টেরয়েডস ও মার্কারি থাকে; সেগুলো প্রদাহ, ত্বক পাতলা করে। এমনকি নবজাতককে অস্বাভাবিক করতে পারে, যদি গর্ভাবস্থা ও দুগ্ধদানের সময় মা ওই সব পণ্য ব্যবহার করে।
মুম্বাইয়ের ত্বক বিশেষজ্ঞ ড. বাটুল প্যাটেল বলেছেন, ‘এসব পণ্য ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস ও ভাইরাস বহন করে। এসব কারণে কয়েকটি দেশে ফেয়ারনেস পণ্যে স্টেরয়েড ও মার্কারির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
গবেষকরা বলছেন, মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকিও রয়েছে। মনোবিদ ড. সাগর মুনদাদা বলেন, ‘ত্বক ফর্সাকারী পণ্য সামান্যই ফর্সা করতে পারে, কিন্তু মানুষ আরো বেশি আশা করে। এটা তাদের অসুখী করে তোলে, আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলে।’
ভারতের ব্যবসায়ী ধাবাল দেব বলেছেন, ‘আমি কখনোই ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করিনি। কারণ আমার এসবে বিশ্বাস নেই। আমি আমার রং নিয়ে গর্বিত— সবার তা-ই হওয়া উচিত। যা আমি নই, তা হতে চাই না।’
গবেষণাপত্র যা জানাল
* অংশগ্রহণকারীদের যারা ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করে, তাদের ৬৩ শতাংশের বয়সসীমা ১৮ থেকে ২৪
* ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ও ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ গৃহিণী নিয়মিত ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করে
* ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারী ও ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ জানায়, মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা ক্রিম ব্যবহার করেছে
* ৬৩ শতাংশের কাছাকাছি নারী-পুরুষ মনে করে ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করলে আকর্ষণীয় দেখায়
আইন জরুরি
ফেয়ারনেস পণ্যের বাজার বেশ বড়। তাই এ পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনে নির্দিষ্ট কানুন থাকা জরুরি। কী উপাদান ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কানুন থাকা দরকার। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হতে হবে।