ক্লাস শেষে মাছ বিক্রি, হিজাব না পরায় তরুণীর সমালোচনা
হানান হামিদ ভারতের কেরালা রাজ্যের মেয়ে। বয়স ২১ বছর। মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই রোগগ্রস্ত মা বিছানায়, ছোট ভাইটি স্কুলে পড়ে। পরিবারে উপার্জনের আর কেউ না থাকায় হানানকেই নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে সব দায়-দায়িত্ব। মায়ের চিকিৎসার খরচ, ভাইকে পড়ানোর পাশাপাশি নিজের লেখাপড়াও খরচও জোগাতে হয় হানানকে।
দাঁতে দাঁত চেপে একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন হানান হামিদ। পাশে পাননি আর কাউকে। তবু অদম্য হানান নিজের লক্ষ্যে। নিজের পরিশ্রমে কোনোভাবে চলে যাচ্ছিল হানানের জীবন। হানানের জীবনের এই কঠিন বাস্তবতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পরই রীতিমতো সেলিব্রেটি হয়ে ওঠেন হানান। তাঁকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় মাতামতি। আর এর মধ্যেই হঠাৎ করেই তাতে উড়ে এসে জুড়ে বসে নানা সমালোচনার বাণ। কেন হিজাব না পরেই হানান বাজারে দোকান সাজিয়ে বসেছেন, শুনতে হচ্ছে সেই সমালোচনাও। তবে শত সমালোচনার মধ্যেও হানানের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
কেরালা রাজ্যের কোচির মাধবনা এলাকার বাসিন্দা হানান হামিদ। স্থানীয় থোড়-পুঝার একটি বেসরকারি কলেজে রসায়নশাস্ত্রে স্নাতক শ্রেণির চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বাড়ির পাশের বাজারে গিয়ে মাছ কিনে পাশের এক বন্ধুর বাসায় ফ্রিজে রেখে আসেন। এরপর বাসায় এসে একটু পড়াশোনা করে সাড়ে ৭টা নাগাদ বাস ধরে বাড়ি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে কলেজে চলে যান হানান।
কলেজ শেষ করে হানান ওই মাছ নিয়ে এরনাকুলামের খাম্মানাম বাজারে বসে মাছ বিক্রি করেন প্রতিদিন। মাছ বিক্রির লাভের অর্থ দিয়ে চাল, ডাল, সবজি, মায়ের ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরেন।
সংসার চালাতে গিয়ে হানানের এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের খবর গত বুধবার প্রকাশিত হয় জনপ্রিয় মালয়ালাম পত্রিকা ‘দৈনিক মাতৃভূমি’তে। এরপর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কার্যত সেলিব্রেটি হয়ে যায় হানান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় হানানের জীবনের গল্প। সাধারণ মানুষ থেকে রাজনীতিবিদ, পরিচালক সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যায় হানানের এই সংগ্রামী জীবনের গল্প।
অসংখ্য শুভেচ্ছা আসতে থাকে হানানের কাছে। সেইসঙ্গে আসতে থাকে আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতিও। এমনকি হানানের সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছে রয়েছে, এ কথা জানতে পেরে চিত্রপরিচালক অরুণ গোপী তাঁর পরের ছবিতে হানানকে শিল্পী হিসেবে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। গোপীর পরবর্তী ছবিতে হানানের পাশাপাশি অভিনয় করার কথা রয়েছে মালয়ালাম সুপারস্টার মোহনলালের ছেলে প্রণব মোহনলালের।
এই পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল। এরপরই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সক্রিয় হয়ে ওঠে সমালোচকরা। তাদের মধ্যে অনেকেই কুৎসা করে বলতে শুরু করে, হানানের মাছ বিক্রি করে সংসার চালানোর ঘটনাটি পুরোটাই বানানো। সেটি নাকি ছবির প্রচারের কৌশল। কেউ কেউ আবার প্রশ্ন তোলেন, হানান একজন মুসলিম নারী হয়ে মাথায় হিজাব না পরে কীভাবে বাজারে মাছ বিক্রি করতে পারে?
এতসব সমালোচনার মুখে একপর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়েন হানান। বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। জানিয়ে দেন, ‘আমি কোনো সহায়তা চাই না। দয়া করে, আমায় একটু একা থাকতে দিন এবং বেঁচে থাকার জন্য যেকোনো কাজ করার অনুমতি দিন।’
তবে স্বস্তির কথা, সমালোচকদের একহাত নিয়ে হানানের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। তিনি জানান, যে পরিস্থিতিতে হানান লড়াই চালাচ্ছে, তাতে আমি গর্বিত। অন্য নারীদেরও বলব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণার কারণে তাঁরা যেন মনোবল না হারান। তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া হলো দুইদিকে ধারওয়ালা তরবারি। এটি ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কে জে আলফোনসও হানানের সমর্থনে ও সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন।
হানানের প্রতিবেশীরা ও কলেজের অধ্যক্ষ জানিয়েছেন, পত্রিকায় হানানকে নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা মিথ্যা বা বানানো নয়, সত্যি।
সবশেষ জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হানানকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে কেরলের কোচি পুলিশ। কোচির ওয়েইনাড থেকে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই ব্যক্তির নাম নুরুদ্দিন শেখ।