আইএসের যুদ্ধক্ষেত্রে মিতাতের ভয়ংকর চার বছর
অনলাইনে একটি ডেটিং সাইটের মাধ্যমেই আহমেদ খলিলের সঙ্গে পরিচয় হয় ইসলাম মিতাতের। এর পর তা গড়ায় বিয়ে পর্যন্ত। কিন্তু সেই বিয়ে তাঁর জীবনে ভালোলাগা আর ভালোবাসা বয়ে আনার পরিবর্তে শেষ পর্যন্ত দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।
মরক্কোর মেয়ে মিতাতের স্বপ্ন ছিল ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার। কিন্তু আহমেদ খলিলের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর স্বপ্নপূরণ তো দূরের কথা, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিরিয়ায় গিয়ে কথিত ইসলামী স্টেটের (আইএস) ‘খিলাফত রাষ্ট্রে’ বন্দি হয়ে পড়ে মিতাতের জীবন।
এরপর দ্রুতই কেটে যায় চারটি বছর। আর এই চার বছরেই পরপর তিনটি বিয়ে করতে হয় মিতাতকে। জন্ম নেয় দুই সন্তান। বর্তমানে উত্তর সিরিয়ার লিমবোতে দুই শিশুসন্তানসহ আটক আছেন ইসলাম মিতাত। আইএসের অধীনে কী রকম দুর্বিষহ ছিল তাঁর জীবন, সে কথাগুলোই বলেছেন মিতাত।
সিএনএনের দুই প্রতিবেদক এক প্রতিবেদনে মিতাতের সেই ভয়াবহ জীবনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।
মিতাত জানান, আফগানিস্তানের আহমেদ খলিলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় অনলাইনে ‘মুসলিম ডেটিং’ নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। কিন্তু ‘মুসলিম ডটকমে’ যখন তাঁদের সাক্ষাৎ হয়, তখন খলিল ছিলেন যুক্তরাজ্যের নাগরিক।
অনলাইনে প্রথম সাক্ষাতের কয়েক মাস পর খলিল এক নারীকে নিয়ে মরক্কোতে যান। ওই নারীকে নিজের বোন বলে পরিচয় দেন তিনি। সেখানে গিয়ে খলিল মিতাতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন। সে সময় তাঁর উদ্দেশ্য সৎ বোঝাতে খলিল ব্যাংকের স্টেটমেন্টও মিতাতের পরিবারের লোকজনকে দেখান।
বিয়ের পর এ দম্পতি দুবাই ভ্রমণে যান। সেখান থেকে আফগানিস্তানের জালালাবাদে গিয়ে খলিলের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা। মরক্কোতে ফেরার আগে আফগানিস্তানে তাঁরা মাত্র এক মাস ছিলেন। কারণ, সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি মোটেও ভালো ছিল না।
‘যখন আমরা দুবাইয়ে ছিলাম, তখন খলিল আমাকে বলে, তোমার জন্য আমার একটা সারপ্রাইজ আছে। কিন্তু সেটা আমি তোমাকে তুরস্কে গিয়ে দেবো। সিরিয়ায় যাওয়াটা ছিল সারপ্রাইজ’, বলেন মিতাত। যখন তিনি খলিলের কাছে এ বিষয়ে জানতে চান, তখন খলিলের জবাব ছিল একেবারেই কাঠখোট্টা। খলিল বলে, ‘তুমি আমার স্ত্রী এবং আমার বাধ্যগত।’
মিতাত বলেন, ‘খলিল আমাকে নিয়ে তুরস্কে হলিডেতে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু সেই হলিডের যাত্রা ছিল অদ্ভুত। কোনো রিসোর্ট বা হোটেলের কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়নি। তার পরিবর্তে সিরিয়ার কাছাকাছি তুরস্কের দক্ষিণাংশে একটি সীমান্তে আশ্রয় নিই আমরা।’
মিতাত জানান, তিনি এই বিপজ্জনক অবস্থার কথা তুরস্কের সীমান্তরক্ষীদের জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা দেখতে পান, সিরিয়ার সীমান্ত দিয়ে যাঁরা পালাচ্ছেন, নিরাপত্তা বাহিনী তাঁদের গুলি করছে। যা দেখে মিতাত ও তাঁর সঙ্গে থাকা অন্যরা ভয়ে তটস্থ হয়ে যান।
এরপর তুরস্কের ভাষা জানা এক ব্যক্তি মিতাত ও খলিলকে একটি বাড়িতে পৌঁছে দেন। বাড়িটি নারী ও বাচ্চা-কাচ্চায় পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে নারী ও বাচ্চারা একটি কক্ষে আর পুরুষরা অন্য আরেকটি কক্ষে থাকতেন বলে জানান মিতাত।
এ ঘটনা দেখার পর হতভম্ব হয়ে যান মিতাত। তিনি সেখানে থাকা অন্য নারীদের জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন? তখন তাঁরা বলেন, ‘আমরা সিরিয়ায় হিজরতে যাচ্ছি।’
এরপর তাঁরা দেশটির জারাবুলস শহরে ‘মুহাজারিন’ নামের একটি গেস্টহাউসে যান। সেখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই খলিলকে এক মাসের মিলিটারি প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। যে সময় মিতাত গর্ভবতী ছিলেন।
এরপর প্রশিক্ষণ শেষে খলিলকে যুদ্ধে পাঠায় আইএস। কোবানিতে যুদ্ধের প্রথম দিনেই খলিল মারা যান। এরপর মিতাত বুঝে উঠতে পারেন না, তিনি কী করবেন। তাঁকে মুহাজারিন সম্প্রদায়ের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা হয়। এরপর ছেলে আবদুল্লাহ জন্ম নেওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানে থাকেন।
এরপর আইএসের চাপে পড়ে মিতাত তাঁর প্রথম স্বামীর বন্ধু আবু তালহা আল-আলমানিকে বিয়ে করেন। এরপর তিনি তাঁকে সিরিয়ার আলেপ্পোর মানবিজে নিয়ে যান। এক মাস পর মিতাত আবু তালহাকে তালাক দেন।
তালাক দিয়েও রক্ষা হয়নি মিতাতের। তাঁকে বাধ্য করা হয় তৃতীয় বিয়ে করতে। এরপর তিনি আবু আবদুল্লাহ আল-আফগানি নামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন ভারতীয়। আর তাঁর মা থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। মিতাত বলেন, আফগানি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হতে পারেন।
অবশেষে দুই বছর বয়সী ছেলে আবদুল্লাহ ও ১০ মাস বয়সী মেয়ে মারিয়াকে নিয়ে সিরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী শহর রাক্কা থেকে পালিয়ে আসেন ইসলাম মিতাত।
ওই পরিবারটি বর্তমানে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার পিপলস প্রটেকশন ইউনিট বা ওয়াইপিজি সেফ হোমে অবস্থান করছে।