রাজদায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন ‘নিন্দিত’ রাজকুমার অ্যান্ড্রু
রাজকীয় দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটেনের বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের তৃতীয় সন্তান ডিউক অব ইয়র্ক রাজকুমার অ্যান্ড্রু। যৌন সম্পর্ক, মেয়ে পাচার ও নারীঘটিত অন্যান্য কেচ্ছায় জড়িত প্রভাবশালী মার্কিন ধনকুবের জেফ্রি এপস্টেইনের সঙ্গে মেলামেশা করে কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে রাজপরিবারে ‘বড় ধরনের গোলোযোগ’ সৃষ্টি করেছেন জানিয়ে এমন সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন অ্যান্ড্রু।
মায়ের অনুমতি নিয়েই ‘আসন্ন ভবিষ্যতের’ কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান ৫৯ বছর বয়সী রাজকুমার অ্যান্ড্রু।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডিউক অব ইয়র্ক অ্যান্ড্রু স্বীকার করেন, জেফ্রি এপস্টেইনের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখা তাঁর উচিত হয়নি। এর পর থেকেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন রাজকুমার অ্যান্ড্রু।
বিবিসির ওই সাক্ষাৎকারের পর এরই মধ্যে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিন্ন করেছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, দাতব্য সংস্থা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
এদিকে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর রাজদায়িত্ব থেকে সরে যাওয়াকে ‘ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত’ বলে জানিয়েছে বাকিংহাম প্রাসাদ। রানি ও বড়ভাই রাজকুমার চার্লসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই রাজকুমার অ্যান্ড্রু এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ব্রিটিশ রাজপরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এক বিবৃতিতে রাজকুমার অ্যান্ড্রু বলেন, ‘জেফ্রি এপস্টেইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রাখার জন্য অনুশোচনায় পুড়ছি। ওর সঙ্গে মেলামেশা করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। সে আত্মহত্যা করায় অনেক প্রশ্নের উত্তরই অজানা থেকে গেছে। বিশেষ করে যাঁরা তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরাই বেশি ভুগছেন। আমি তাঁদের সবার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।’
রাজকুমার অ্যান্ড্রু আরো বলেন, ‘আমি কেবল এটুকুই বলতে পারি, আশা করছি সময়ের পরিক্রমায় তাঁরা নিজেদের জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারবেন।’
‘যদি প্রয়োজন হয়, যেকোনো যথাযথ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তদন্তে সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি,’ যোগ করেন রাজকুমার অ্যান্ড্রু।
কী করেছেন রাজকুমার অ্যান্ড্রু?
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার একটি আদালতে এপস্টেইনের বিরুদ্ধে চলা একটি মামলার সূত্রে ২০১৫ সালের শুরুর দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার আদালতে মার্কিন ধনকুবের জেফ্রি এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের শিকার কয়েক নারী একটি অভিযোগ দায়ের করেন। এতে যুক্তরাজ্যের ডিউক অব ইয়র্ক প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ আনেন ভার্জিনিয়া রবার্টস (বর্তমানে তাঁর নাম ভার্জিনিয়া) নামের এক নারী। ভার্জিনিয়া রবার্টস দাবি করেন, ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে তাঁকে লন্ডন, নিউইয়র্কে ও এপস্টেইনের ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ক্যারিবীয় দ্বীপে আয়োজিত উন্মত্ত পার্টিতে তিনবার অ্যান্ড্রুর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করা হয়। ওইসব পার্টিতে প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জনের জন্য ভার্জিনিয়ার মতো আরো অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে রাখা হতো।
ওই সময় ভার্জিনিয়ার বয়স ছিল ১৭ বছর। ফ্লোরিডার আইন অনুযায়ী, সে সময় ভার্জিনিয়া ছিলেন নাবালিকা। অভিযোগ রয়েছে, মার্কিন ধনকুবের এপস্টেইন দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে রাখতে এভাবেই ‘যৌনদাসী’ জোগান দিতেন।
এদিকে মার্কিন কিশোরী ভার্জিনিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরা অ্যান্ড্রুর ছবি প্রকাশ্যে আসতেই ব্রিটিশ রাজকুমারের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ পোক্ত হয়। এ ছাড়া এপস্টেইনের ম্যানহাটনের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর এক তরুণীর দিকে হাত নাড়ার একটি ছবিও সে সময় প্রকাশ হয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের তৃতীয় সন্তান অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে ‘তথ্য-প্রমাণের’ অভাব ছিল না।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। আরো একটি বিষয় সামনে উঠে আসে। ২০১০ সালে নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে এপস্টেইনের সঙ্গে তোলা অ্যান্ড্রুর একটি ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর ২০০৮ সালে এক নাবালিকাকে প্রকাশ্যে যৌনবৃত্তিতে নামার প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগে জেল খাটেন এপস্টেইন। এমন ‘কুখ্যাত’ ব্যক্তির সঙ্গে ব্রিটিশ রাজকুমারের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি কোনোদিন স্বীকার করেনি ব্রিটিশ রাজপরিবার। অবশেষে এপস্টেইনের মৃত্যুর তিন মাস পর নীরবতা ভাঙলেন অ্যান্ড্রু নিজেই।
চলতি বছরের আগস্টে নিউইয়র্কের একটি জেল থেকে উদ্ধার হয় ৬৬ বছর বয়সী এপস্টেইনের মরদেহ। অপ্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে যৌন সংসর্গের দায়ে কারাভোগ করছিলেন এপস্টেইন। তদন্তে উঠে আসে, বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন আত্মঘাতী হন এপস্টেইনে। এ ঘটনার পরপরই আবারও এপস্টেইন-অ্যান্ড্রু সম্পর্ক নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। সম্প্রতি বিবিসির নেওয়া সাক্ষাৎকারে এপস্টেইনের সঙ্গে মেলামেশার কথা স্বীকার করেন রাজকুমার অ্যান্ড্রু। ব্রিটিশ রানির অনুমতি নিয়ে বাকিংহাম প্যালেসেই নেওয়া হয় ওই সাক্ষাৎকার। যদিও এত কিছুর পরও ভার্জিনিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের যৌন সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন রাজকুমার অ্যান্ড্রু।
মার্কিন নারী ভার্জিনিয়ার দাবি অনুযায়ী, ২০০১ সালে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর সঙ্গে নৈশভোজ সেরে তাঁরই এক বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়েছিলেন দুজন। সাক্ষাৎকারে সে প্রসঙ্গ ওঠায় অ্যান্ড্রু বলেন, ‘এই নারীর সঙ্গে কখনো কোথাও দেখা হওয়ার কথা মনে করতে পারছি না।’
তা হলে এপস্টেইনের ‘কুকর্মের’ কথা জানার পরও কেন তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যান্ড্রু বলেন, ‘এই কাজের জন্য প্রতিদিন নিজেকে দোষারোপ করেছি। রাজপরিবারের সদস্য হয়ে এমন কাজ ঠিক হয়নি। ব্রিটিশ রাজপরিবার যে উচ্চ সম্মান ও আচরণ বজায় রাখে, সেটার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছি।’
এপস্টেইনের মতো দাগি যৌন হেনস্তাকারীর বাড়িতে থাকা প্রসঙ্গেও মুখ খোলেন অ্যান্ড্রু। তিনি বলেন, ‘তখন সেটাই সুবিধাজনক মনে হয়েছিল। পরে বোধোদয় হওয়ার পরে বুঝেছি, আমি ভুল করেছি।’
তবে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে ভার্জিনিয়ার সঙ্গে যৌন সম্পর্কের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে বাকিংহাম প্যালেস।