‘জানলামও না মানুষটা কেমন’, দিল্লির সহিংসতায় স্বামীহারা নববধূর হাহাকার
বিয়ের দুই সপ্তাহ না পেরোতেই ভেঙে গেল ২১ বছরের তাসনিম ফাতিমার সব স্বপ্ন। তড়িঘড়ি করে দুপুরে ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সদ্য বিবাহিত ২২ বছরের আশফাক হুসেইন। আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাঁর। আশফাকের মৃতদেহের জন্য অপেক্ষায় বসে রয়েছে গোটা পরিবার। তিনদিন ধরে গায়ে জ্বর নিয়ে ঘরের কোণে পড়ে রয়েছেন আশফাকের স্ত্রী তাসনিম ফাতিমা। ঘুমের মধ্যেও মৃত স্বামীকে খুঁজছেন তিনি। স্বামীকে জানার, চেনার সুযোগটাই যে পেলেন না ফাতিমা।
ভারতী সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের পূর্ব দিল্লির গোকুলপুরী এলাকার অন্তর্গত মুস্তফাবাদের ঘিঞ্জি গলির এক পাশে কোনো রকমে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই। সপরিবারে সেখানেই থাকতেন আশফাক হুসেইন। পেশায় তিনি একজন বিদ্যুৎকর্মী। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের সাখনিতে তাসনিমের সঙ্গে বিয়ে হয় আশফাকের। ভেবেছিলেন বিয়ের পর দিল্লিতে তাসনিমকে নিয়ে নতুন জীবনে পা রাখবেন।
কাজের প্রয়োজনে গত রোববার রাতে একাই মুস্তফাবাদের বাসায় ফিরে আসেন আশফাক। ঠিক ওই সময়ই জাফরাবাদ ও মৌজপুরে বিক্ষোভ শুরু হয়। উত্তরপ্রদেশেও সে খবর পৌঁছায়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে রওনা দিয়ে পরদিন দিল্লি আসেন তাসনিমও। নতুন বউ হিসেবে ওই দিন তাঁর কাঁধেই রান্নার ভার পড়ে। রান্নাবান্না সেরে দুপুর ২টা নাগাদ সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সারেন। সেই প্রথম পাশাপাশি বসে খাওয়ার সুযোগ হয় তাসনিম ও আশফাকের।
কিন্তু খাওয়ার পরই আশফাকের কাছে একটি ফোনকল আসে। বলা হয়, পাড়ায় একটি বাড়িতে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেছে। তাঁকে গিয়ে দেখতে হবে। সে অনুযায়ী ১২ দিনের নবপরিণীতাকে রেখে বাড়ি থেকে বের হন আশফাক। দুজনের সেটাই শেষ দেখা। তারপর আর বাড়ি ফেরেননি আশফাক। বাড়ি থেকে কিছু দূর এগোতেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরিবারের লোকজন কিছু জানার আগে স্থানীয়রাই তাঁকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই মৃত্যু হয় আশফাকের। ময়নাতদন্তের জন্য পরে গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আশফাকের দেহ। কিন্তু গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত তাঁর মরদেহ হাতে পায়নি পরিবার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেন, গত রোববার রাত থেকেই বন্দুক, লাঠি ও পেট্রল বোমা নিয়ে মুস্তফাবাদে ঢুকতে শুরু করে বিক্ষোভকারীরা। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস বাহিনীকে একাধিক বার ফোন করা হলেও, কারও দেখা মেলেনি। গত বুধবার এলাকায় অ্যাম্বুলেন্সও ঢুকতে পারেনি। এলাকার একটি মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতকারীরা। আগুন ধরানো হয় একটি স্কুলেও। একাধিক বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। আশফাকের চাচা মুক্তার আহমেদ দাবি করেন, পুলিশ সময়মতো দায়িত্ব পালন করলে পরিস্থিতি এতদূর গড়াত না। তিন দিন ধরে ছেলের কর্মস্থলে বসে চোখের পানি ফেলছেন আশফাকের বাবা। শুধু নিজের ছেলে নয়, চারদিনব্যাপী সহিংসতায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে শহিদ ঘোষণা করতে হবে বলে দাবি তাঁর। সরকার অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেবে বলে আশাবাদী তিনি।
কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই তাসনিম। বাড়ির একটি ঘরে তিন দিন ধরে জ্বর নিয়ে পড়ে আছেন তিনি। এই তিন দিনে একটি পানি পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেননি। তাসনিমের মুখে একটাই আফসোস, ‘মানুষটা কেমন, তা জানতেও পারলাম না।’