যেভাবে হলো পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। আজ শনিবার কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম বিভ্রাট, একাধিক কেন্দ্রে ভোট দিতে না পারার ক্ষোভ, গাড়ি ভাঙচুর ও কয়েক জায়গায় প্রার্থীকে হেনস্থার অভিযোগের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ভোটগ্রহণ।
সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে গণমাধ্যমের কর্মীরাও আক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রথম ধাপে রাজ্যের পাঁচ জেলা পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুরের ৩০টি আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যবিধি ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ভোটগ্রহণ শুরু হয় সকাল ৭টায় এবং চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত।
এদিন সকালেই সহিংসতার ঘটনা ঘটে শালবনিতে। সেখানকার সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত সিপিআইএম প্রার্থী সুশান্ত ঘোষের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
সকালে শালবনির ছোটতারা ভোটকেন্দ্রে সুশান্ত ঢুকলেই উত্তেজনা শুরু হয়। তাঁর গাড়িতে হামলা চালায় কয়েকজন যুবক। ধাক্কা মারা হয় তাঁর গাড়িতে। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। এমনকি সুশান্তকে পেছন থেকে ধাক্কা মারা হয়। পরে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে গাড়িতে তুলে দেন। সেই সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপরও আক্রমণ চালানো হয়।
বেলা গড়াতেই কাঁথি দক্ষিণের সাবাজপুরে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই ও কাঁথি পৌরসভার সাবেক প্রশাসক সৌমেন্দু অধিকারীর গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ হামলার ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া সৌমেন্দুর গাড়ির কাঁচ ভেঙে দেওয়া হয়। আহত হন তাঁর গাড়ির চালক।
সৌমেন্দুর অভিযোগ, সাবাজপুট বুথে তৃণমূলের ভোট কারচুপির অভিযোগ পেয়ে সেখানে যাওয়ার পথে হামলার মুখে পড়েন তিনি।
পুরুলিয়া শহরের ১২৭ নম্বর বুথের বাইরে তৃণমূল ও বিজেপি কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা ঘিরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এলাকাটি। পুরুলিয়ার তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সুজয় ব্যনার্জি এক বিজেপি কর্মীকে গুলি করে দেওয়ার হুমকিও দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপরই সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যরা।
পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরে ‘ভোট দিতে গেলেই কেটে ফেলব’ বলে ধারালো অস্ত্র হাতে নিয়ে ভোটারদের রীতিমতো ধমকাতে দেখা যায় এক যুবককে। পটাশপুরের চক গোপালপুর এলাকায় ধান ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওই হুমকি দিতে দেখা যায় ওই যুবককে। খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছায় কেন্দ্রীয় বাহিনী।
বান্দোয়ান বিধানসভার ২৬৪ নম্বর বুথে বিজেপির পোলিং এজেন্টকে মারধরের অভিযোগ ওঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বান্দোয়ানেই গ্রামের একটি ক্লাবের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার সময় কয়েকজন তৃণমূল কর্মীকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা লাঠিপেটা করেছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
কাঁথি দক্ষিণ কেন্দ্রের মাজনায় ভোটাররা ইভিএম বদলের দাবি তুলে অভিযোগ করেছে, তারা যে দলের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন সেখানে ভোট না পড়ে তা চলে যাচ্ছে বিজেপিতে। যদিও প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এই ঘটনায় ওই ভোটেকেন্দ্রে বেশ কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। এই অভিযোগে কাঁথি দক্ষিণ বিধানসভায় মাজনা এলাকায় দেপাল রাজ্য সড়কে বিক্ষোভ করে এলাকার মানুষ।
এ ছাড়াও একাধিক জায়গা থেকে ইভিএম বিভ্রাটের খবর পাওয়া গেছে। ফলে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বেশ কিছু জায়গায় ভোটাররা ফিরে যান বলে জানা গেছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয় তৃণমূলের একটি প্রতিনিধি দল। তাদের অভিযোগ, প্রথম দফায় অন্তত ১৫টি কেন্দ্রে সিআরপিএফ প্রভাব খাটাচ্ছে। বহিরাগতরা অবাধে বুথে ঢুকছে।
যদিও সব কিছুকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক বিজেপি নেতাকে ফোন করে আসন্ন ভোটে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফ থেকে সাহায্য চাওয়ার ঘটনা। মমতা এবং ওই বিজেপি নেতার মধ্যে টেলিফোনে কথাবার্তার অডিও ক্লিপ সামনে আসায় তোলপাড় শুরু হয়েছে রাজ্যজুড়ে।
আগামী ১ এপ্রিল নন্দীগ্রাম আসনে ভোট। এর আগে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি প্রলয় পালকে টেলিফোন করে মমতা তাঁর কাছে ভোটে সহায়তা করার অনুরোধ জানান বলে অভিযোগ ওঠেছে। শনিবারই ওই অডিও ক্লিপ প্রকাশ্যে আনে বিজেপি। সেখানে মমতাকে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি ইয়ং ছেলে, অনেক কাজ করো। এবার আমাদের একটু সাহায্য করে দাও। দেখবে কোনো অসুবিধা হবে না।’
অডিও ক্লিপে অপর প্রান্তে থাকা বিজেপির প্রলয় পালকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনাকে (মমতা) দেখে আমাদের পরিবার রাজনীতি করেছে। আপনার আদর্শ মেনে রাজনীতি করেছি। ২০১১ সালের ভোটের ফল ঘোষণার পর ব্রাহ্মণ ডেকে যজ্ঞ করে মিটিং মিছিল করেছিলাম। তবু আমি একটা রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট পাইনি।’
এরপর নিজের ক্ষোভ অভিমানের কথা জানান ওই বিজেপি নেতা। তিনি বলেন, ‘দিদি আপনি যাই মনে করুন এখন দল থেকে বেরিয়ে এসেছি। যখন যে দলের সঙ্গে রয়েছি, সেই দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। যখন যে দল করি, প্রাণ দিয়ে সেই দলটাই করি। আমাকে ক্ষমা করুন।’
পরে সংবাদমাধমের সামনে প্রলয় নিজেই জানান, ‘রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে প্রার্থী হয়েছেন। আজকে ওনার আমার কথা মনে পড়েছে। তাই ফোন করে সমর্থন চাইছেন। আমি যাতে ওনার দলের হয়ে কাজ করি ও ফিরে যাই। আমরা বিজেপি করি। দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যখন সিপিআইএমের অত্যাচার চলত, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকার পরিবার। কেউ আসেনি সেই সময়।’
প্রলয় আরও বলেন, ‘দিদি যাই করুক না কেন, আমরা শুভেন্দু অধিকারীর জন্য লড়াই করছি, আর লড়াই করব। শুভেন্দু অধিকারীকে নন্দীগ্রামের বিধায়ক হিসেবে নবান্নে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। সেটা করে দেখাব।’
এই অডিও ক্লিপ নিয়ে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘মমতার সৌজন্যতাকে দুর্বলতা ভাবার কোনো কারণ নেই। কোনো নেতা যদি দুঃখ-অভিমানে দল থেকে দূরে সরে যান, তাকে ফেরানোর চেষ্টা করায় অন্যায় কোথায়?’
যদিও বিজেপির কটাক্ষ তাদের জেলা নেতার কাছে ভোট ভিক্ষা করছে একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিষয়টি নিয়ে তারা এদিন নির্বাচন কমিশনেরও দ্বারস্থ হয়।
বাংলায় প্রথম ধাপে মোট ভোটারের সংখ্যা ৭৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৪২ জন। পুরুষ ভোটার ৩৭ লাখ ৫২ হাজার ৯৩৮ এবং নারী ভোটার ৩৬ লাখ ২৭ হাজার ৯৪৯ জন। মোট ১৯১ জন প্রার্থী হয়। নারী প্রার্থী ২১ জন ও পুরুষ ১৭০ জন।
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে শনিবার থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যেও বিধানসভার নির্বাচন শুরু হয়েছে। এদিন প্রথম ধাপে ৪৭টি বিধানসভা আসনে ভোটগ্রহণ হয়। এই রাজ্যের মোট ১২৬টি আসনে তিন ধাপে ভোটগ্রহণ হবে। মোট প্রার্থী হয়েছেন ২৬৪ জন। মোট ভোটারের সংখ্যা ৮১ লাখ নয় হাজার ৮১৫ জন। আসামে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আশা, প্রথম ধাপে ৪৭টি আসনের মধ্যে অন্তত ৪৪টি আসনে জয় পাবে ‘বিজেপি-আসাম গণ পরিষদ-ইউনাইটেড পিপলস পার্টি লিবারেল’ জোটের প্রার্থীরা।
অন্যদিকে রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি রিপুন বরা আশাবাদী, কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোটের প্রার্থীরা ৩০টি আসনে জয় পাবে। ভোটগ্রহণ শেষে ইভিএম সিল করার কাজ চলছে ও সেগুলো কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে স্ট্রং রুমে রাখা হবে।
আগামী ২ মে এই ইভিএমগুলো খুলে গণনার কাজ শুরু হবে। সেদিনই জানা যাবে বাংলায় তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূল কংগ্রেসই ক্ষমতায় আসবে না কি বিজেপি বাংলার মাটিতে পদ্মফুল ফোটাবে।