বাড়ছে তাপমাত্রা, মহাসাগরে ফুরিয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন
মহাসাগরগুলো থেকে ফুরিয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন। যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মাছের অসংখ্য প্রজাতি। অক্সিজেন কমে যাওয়ার জন্য দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণ। পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
মহাসাগরগুলোতে পুষ্টিমান কমে যাচ্ছে, এমন তথ্য বেশ কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা জানতেন। এখন গবেষকরা বলছেন, মহাসাগরের পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। গবেষকদের ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়ছে টুনা, মার্লিন ও হাঙরের মতো অনেক বড় মাছ। কারণ, বড় মাছগুলোর বেশি শক্তির দরকার হয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
আইইউসিএনের গবেষণায় বলা হয়, সারা বিশ্বে সাতশর বেশি সামুদ্রিক এলাকা বর্তমানে অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগছে। অথচ ১৯৬০-এর দশকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ।
মহাসাগরে পুষ্টি-দূষণের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষি খামার ও শিল্পকারখানা থেকে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস পানিতে গিয়ে মিশছে।
এ ছাড়া বিজ্ঞানীরা জানতেন, এই দূষণ সমুদ্রের পানিতে থাকা অক্সিজেনের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। তবে এত দিন বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, শুধু উপকূলীয় এলাকার সমুদ্রেই এ দূষণ প্রভাব ফেলছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে হুমকির মাত্রা।
গ্রিনহাউসের কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধি পাওয়ায়, মহাসাগরগুলোকে আরো বেশি তাপ শুষে নিতে হচ্ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে মহাসাগরের উষ্ণতা। এই উষ্ণ পানি কম অক্সিজেন ধরে রাখতে পারছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, ১৯৬০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মহাসাগরের পানি থেকে কমে গেছে ২ শতাংশ অক্সিজেন। সারা বিশ্বের অক্সিজেনের বিবেচনায় এটি খুব বেশি মনে নাও হতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় অক্সিজেন হ্রাসের এই হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
খুব সামান্যতম পরিবর্তনও সামুদ্রিক জীবনযাত্রার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন কম অক্সিজেনসমৃদ্ধ পানি জেলিফিশের মতো প্রাণীর জন্য উপকারী হতে পারে, কিন্তু টুনা মাছের মতো বড় ও দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে, এমন প্রাণীর জন্য সেটি সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।
আইইউসিএনের কর্মকর্তা মিন্না ইপস বলেন, ‘অক্সিজেন হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি আমরা জানতাম, কিন্তু এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক এবং তা কতটা হুমকি তৈরি করছে, সেটা আমাদের জানা ছিল না।’
‘গত ৫০ বছরে অক্সিজেন হ্রাস পাওয়ার হার যে চারগুণ হয়ে গেছে তাই নয়, এমনকি যেসব জায়গায় কার্বন নিঃসরণ কম হয়েছে, সেখানেও মহাসাগর থেকে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে,’ যোগ করেন মিন্না ইপস।
গবেষকরা বলছেন, পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়ার কারণে টুনা, মার্লিন ও হাঙরের মতো অনেক প্রাণী সমুদ্রের ওপরের দিকে এসে থাকতে শুরু করেছে। কিন্তু এ কারণে এসব প্রাণী মৎস্যশিকারিদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতেও পড়ে যাচ্ছে।
গবেষকরা মনে করছেন, বিশ্বের দেশগুলো যদি কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো অমনোযোগী মনোভাব দেখিয়ে যায়, তাহলে ২১০০ সাল নাগাদ মহাসাগরে অক্সিজেনের মাত্রা ৩ থেকে ৪ শতাংশ হ্রাস পাবে।
গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় এই হার হবে আরো অনেক বেশি। বেশির ভাগ ক্ষতি হবে সমুদ্রের প্রথম এক হাজার মিটারের মধ্যে, যেখানে সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্য রয়েছে।
অক্সিজেন হ্রাস পাওয়ার ফলে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যচক্রের মতো মৌলিক ক্ষেত্রেও হুমকি তৈরি হবে।
মিন্না ইপস বলেন, ‘আমরা যদি (মহাসাগর থেকে) অক্সিজেন হারিয়ে ফেলি, তাহলে সেখানে প্রাণীগুলোর আবাসস্থল নষ্ট হবে, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে।’
''এই প্রক্রিয়া মহাসাগরের শক্তি এবং জৈব রাসায়নিক চক্র বদলে দেবে। ফলে আমরা এখনো জানি না, এসব জীববৈচিত্র্য ও রাসায়নিক পরিবর্তন মহাসাগরের ভেতরে কী ঘটাবে?’ যোগ করেন মিন্না ইপস।
মহাসাগরে পরিবর্তনের এসব তথ্য বিশ্ব নেতাদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণাটির সহ-লেখক ও আইইউসিএনের গবেষক ড্যান ল্যাফোলে বলেন, ‘মহাসাগরের অক্সিজেন হ্রাস পাওয়ায় মহাসাগরের তাপমাত্রা ও এসিড বেড়ে যাওয়ার কারণে এর মধ্যেই ক্ষতির মুখে পড়েছে মহাসমুদ্রের পরিবেশ।’
‘আমাদের কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ কমাতে হবে ব্যাপক হারে। সেইসঙ্গে কৃষি খামার ও অন্যান্য উৎসের কারণে সমুদ্রে যে পুষ্টি-দূষণ হয় সেটাও বন্ধ করতে হবে,’ যোগ করেন ড্যান ল্যাফোলে।