ইসরায়েল-বাহরাইন-আমিরাত চুক্তি ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ভোর’, বললেন ট্রাম্প
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের ‘ঐতিহাসিক’ চুক্তির দিনটিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ভোর’।
মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ইসরায়েল নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রাখার চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আরব আমিরাত, ইসরায়েল ও বাহরাইনের মতো ট্রাম্পও এ চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতাতেই এ চুক্তি সম্পন্ন হয়। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তৃতীয় ও চতুর্থ উপসাগরীয় দেশ হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিল। এর আগে ১৯৭৯ সালে মিসর এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেছেন, অন্যান্য দেশও আমিরাত ও বাহরাইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। এদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সমাধান হওয়ার আগ পর্যন্ত তেমনটি যেন না হয়, সে আহ্বান জানিয়েছে ফিলিস্তিন।
বছরের পর বছর ধরে সিংহভাগ আরব দেশ ইসরায়েলকে বয়কট করে এসেছে। আরব দেশগুলোর বক্তব্য ছিল, ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের বহু বছর ধরে চলা দ্বন্দ্বের সমাধান হলেই কেবল তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে।
স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জড়ো হওয়া কয়েকশ মানুষের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেন, ‘কয়েক দশকের বিভক্তি ও সংঘাতের পর আমরা নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যের উত্থানের সূচনা করছি।’
ট্রাম্প আরো বলেন, ‘আজ আমরা এখানে ইতিহাস বদলে দিতে জড়ো হয়েছি।’
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান ও বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ আল জায়ানি নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এই দিনটি ইতিহাস পরিবর্তনের ক্ষণ, শান্তির নতুন দিগন্তের সূচনা।’
তবে ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, অধিকৃত অঞ্চল থেকে ইসরায়েল সরে গেলেই কেবল মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
সংবাদ সংস্থা এএফপির খবর অনুযায়ী, চুক্তি স্বাক্ষরের পর মাহমুদ আব্বাস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইসরায়েলের অধিগ্রহণের সমাপ্তি না হলে ওই অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফিরবে না।’
ওদিকে যখন চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছিল, সে সময়ও গাজা উপত্যকা থেকে দুটি রকেট ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
এ চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলা হচ্ছে কেন?
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশ ছিল শুধু মিসর ও জর্ডান। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় আরব লিগের সদস্য মৌরিতানিয়া ১৯৯৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও ২০১০ সালে সম্পর্কচ্ছেদ করে।
এখন দেখার বিষয়, উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে সৌদি আরবও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কিনা। এখন পর্যন্ত সৌদি আরব ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা এ ধরনের কোনো চুক্তি করতে প্রস্তুত নয়।
এ চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে হওয়া পারস্পরিক সম্পর্কের জের ধরে ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ভারসাম্যেও পরিবর্তন আসতে পারে। ইসরায়েলের পাশাপাশি বেশ কিছু আরব রাষ্ট্রেরও ইরানের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক রয়েছে।
কেন এ চুক্তির নিন্দা করছে ফিলিস্তিনিরা?
ফিলিস্তিনিরা মনে করছে, এ চুক্তি করে তাদের সঙ্গে ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে বহু বছরের একটা ঐকমত্য ছিল। সেটি হচ্ছে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক একমাত্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার মাধ্যমেই হতে পারে। ফিলিস্তিনিরা বলছে, এ চুক্তি করে উপসাগরীয় দেশগুলো ওই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত অবশ্য বলছে, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি চুক্তির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ এবং এ চুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলকে রাজি হতে হবে যে পশ্চিমতীরের এক বিরাট ফিলিস্তিনি এলাকা তারা নিজেদের সীমানাভুক্ত করবে না।
গত জানুয়ারি মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বিতর্কিত’ প্রস্তাবিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তিচুক্তির শর্ত অনুযায়ী, পশ্চিমতীরের বড় একটি অংশ ইসরায়েলের সীমানাভুক্ত করার কথা ছিল।
ফিলিস্তিনিরা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাত বলে অভিযোগ করেছিল এবং সতর্ক করেছিল যে ওই সংযুক্তির ফলে ভবিষ্যতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা নষ্ট হবে এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে।
চুক্তি নিয়ে বিতর্কের কারণ
মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইরানের একে অপরের বিরুদ্ধে নেওয়া কূটনৈতিক পদক্ষেপের পেছনের কারণ মূলত ধর্মীয়।
দুদেশের মধ্যে বহু বছর ধরে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের মূল ভিত্তি ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতা। দুদেশ ইসলাম ধর্মের প্রধান দুই শাখার অনুসারী—ইরান মূলত শিয়া মুসলিম এবং সৌদি আরব নিজেদের বিশ্বের শীর্ষ সুন্নি মুসলিম শক্তি হিসেবে মনে করে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন দুদেশই সৌদি আরবের মিত্র।
এ চুক্তির পর সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়ার দিকে নজর থাকবে পুরো বিশ্বের। এখন পর্যন্ত এমন কোনো ইঙ্গিত আসেনি যে তারা বাহরাইন বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের পদক্ষেপ অনুসরণ করবে।