আফগান-তালেবান শান্তি বৈঠকে চোখ ভারত-পাকিস্তানের
কাতারের দোহায় তালেবান ও কাবুল সরকারের মধ্যে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি যে মীমাংসা আলোচনা চলছে, সেদিকে আফগান জনগণের সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে আফগানিস্তানের দুই আঞ্চলিক প্রতিবেশী—ভারত ও পাকিস্তান।
ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দোহার এই বৈঠকে কী মীমাংসা হয়, তার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার এ দুই বৈরী প্রতিবেশীর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে যেদিন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারে তাঁর সংকল্পের কথা প্রকাশ করেন, তখন থেকেই ভারত ও পাকিস্তান ভবিষ্যতে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে বিশেষ তৎপর হয়েছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চাইলেও কীভাবে তা নিশ্চিত হবে, তা নিয়ে দুদেশের অবস্থানে রয়েছে বিশাল ফারাক। বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন, আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে তারা দুদেশ কে কাকে বেশি ঘায়েল করতে পারবে, তা নিয়ে ।
পাকিস্তানের চাওয়া
ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক হাসান আসকার রিজভি বলেন, ‘পাকিস্তান এখন সত্যিই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা চাইছে। কিন্তু তারা চায় এমন একটি সরকার কাবুলে ক্ষমতায় থাকবে, যাদের সঙ্গে ভারতের চেয়ে তাদের ঘনিষ্ঠতা বেশি হবে।’
পাকিস্তান সব সময় বলে আসছে যে তাদের প্রধান চিন্তা আফগানিস্তানের শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং কোন সরকার কাবুলের ক্ষমতায় বসল, সেটা তাদের বিবেচনা নয়। কিন্তু হাসান আসকার রিজভি মনে করেন, পাকিস্তান চায় ভবিষ্যতে কাবুলে যে সরকারই আসুক না কেন, তালেবান যেন তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়।
কেন তালেবানের ওপর পাকিস্তান এত ভরসা করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে হাসান আসকার রিজভি বলেন, ‘যদিও বিষয়টি এমন নয় যে তালেবান এখন পাকিস্তানের কথায় ওঠাবসা করে, সেটা যাঁরা ভাবেন তাঁরা ভেতরের খবর ঠিকমতো জানেন না। কিন্তু তারপরও পাকিস্তান মনে করে, তালেবান ভারতের চেয়ে পাকিস্তানকে প্রাধান্য দেবে। তালেবানের কাছে ভারত একটি অমুসলিম দেশ।’
হাসান আসকার রিজভি আরো বলেন, পাকিস্তানের দৃঢ় বিশ্বাস যে আফগানিস্তানে এক দশকে ভারতের যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, তা তাদের নিরাপত্তার জন্য গভীর হুমকি তৈরি করেছে।
‘পাকিস্তান বিশ্বাস করে, আফগান গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা পাকিস্তানবিরোধী জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে; বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করছে। পাকিস্তান এ অবস্থার পরিবর্তন চায়’, যোগ করেন হাসান আসকার রিজভি।
তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সখ্য দীর্ঘদিনের। ১৯৯০-এর দশকে আফগান গৃহযুদ্ধে তালেবানকে সমর্থন দিয়েছে পাকিস্তান। ১৯৯৬ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর যে মাত্র তিনটি দেশ তাদের বৈধ সরকার বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের একটি ছিল পাকিস্তান।
তালেবানের নেতারা পাকিস্তানের আশ্রয় পেয়েছেন। এমনকি গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের যে শান্তিচুক্তি হয়, তার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের। যুক্তরাষ্ট্রও সেটা একবাক্যে স্বীকার করেছে।
তবে হাসান আসকার রিজভির মতো অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, তালেবান যে পাকিস্তানের সব কথা শুনবে, তা নয়। প্রমাণ হিসেবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দোহায় মীমাংসা বৈঠকে তালেবানের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কট্টরপন্থী ইমাম মুল্লাহ আবদুল হাকিম। কিন্তু পাকিস্তান চেয়েছিল, প্রয়াত তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের ডেপুটি আবদুল গনি বারাদার—যার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস—মীমাংসায় নেতৃত্ব দিক।
কূটনীতিবিষয়ক বিশেষ মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসিতে গবেষক ফাহাদ হুমায়ুন লিখেছেন, তালেবানের শীর্ষ নেতৃত্বে এখন এমন কেউ কেউ উঠে আসছেন, যাঁরা তাঁদের পুরোনো নেতাদের মতো পাকিস্তানের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠ নয় এবং সে সম্পর্কের ইতিহাসও খুব একটা তাঁরা জানেন না।
ফাহাদ হুমায়ুন মনে করেন, নতুন একদল তালেবান নেতা এখন তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় ‘ইসলামাবাদের চেয়ে এখন দোহার দিকেই বেশি তাকান’।
তা ছাড়া হাসান আসকার রিজভি বলেন, আফগানিস্তানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তালেবানের একটি অংশ যেভাবে কট্টর অবস্থান নিয়েছে, পাকিস্তানের মধ্যে তা নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে।
ফাহাদ হুমায়ুন বলেন, ‘পাকিস্তান হয়তো এ মুহূর্তে পুরোপুরি একটি তালেবান সরকার চায় না।’
ফাহাদ হুমায়ুন বলেন, পাকিস্তানের মধ্যে একটি আশঙ্কা এখন কাজ করছে যে আফগানিস্তানে তালেবান যদি পূর্ণ ক্ষমতায় চড়ে বসে, তাহলে একসময় পাকিস্তানের জন্য তা হুমকি তৈরি করতে পারে।
তেহরিকে তালেবানের (টিটিপি) মতো পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠীর সঙ্গে হয়তো আফগান তালেবানের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতে পারে। জাতিসংঘের এক হিসাবে কমপক্ষে ছয় হাজার পাকিস্তানি তালেবান এখন আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধে শামিল রয়েছে।
কিন্তু তারপরও পাকিস্তান মনে করছে, আফগানিস্তানে ক্ষমতায় তালেবানের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ, তাদের কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
কিন্তু আফগানিস্তানে আবারও একটি তালেবান সরকার এবং তাদের নেতৃত্বে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ভারতের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো।
ভারত কেন উদ্বিগ্ন
দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) দক্ষিণ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, ‘তালেবান যদি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের বিরুদ্ধে বেঁকে বসে, তাহলে ভারত ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়বে, যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।’
কারণ অধ্যাপক ভরদ্বাজ মনে করেন, তালেবান ভারতবিরোধী কট্টর ইসলামপন্থীদের সমর্থন করেছে এবং সে কারণেই ভারত সব সময় চেয়েছে শান্তি আলোচনা যেন আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে হয়।
শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নয়, আফগানিস্তানের মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য এবং চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে রেষারেষিতে ভারসাম্যের জন্য ভারতের কাছে আফগানিস্তানের গুরুত্ব অনেক। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ কারণে গত এক দশকে আফগানিস্তানের অর্থনীতি, নিরাপত্তা, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে ভারত তাদের ভূমিকা বাড়িয়েই চলেছে। সামাজিক অবকাঠামো এবং রাস্তাঘাট সেতু, বাঁধ ইত্যাদি প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩০০ কোটি ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি।
এ ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আফগান ব্যাংকিং, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্য খাতে এক হাজার ৭০০ ভারতীয় কাজ করছেন। অনেক ভারতীয় কোম্পানি সে দেশে অফিস খুলে ব্যবসা করছে। আর সে কারণেই আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ভবিষ্যতের রদবদল নিয়ে ভারত চিন্তিত।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দোহার সভায় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অনলাইনে অংশ নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন। ভারতের একজন কূটনীতিক (জেপি সিং) দোহায় হাজির হয়েছেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে তাদের স্বার্থহানি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমাগত দেনদরবার করছে ভারত।
ভারতের তালেবান সমস্যা
ভারত কোনোভাবেই চাইছে না, আফগানিস্তানে তালেবানের প্রভাব এমন হোক, যাতে দেশটি আবার কট্টর একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
ভারত জানে, তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং ভারতকে নিয়ে তালেবানের কোনো আগ্রহ নেই।
তবে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোক সজ্জনহার বলেন, তালেবান এখন আর আগের মতো কট্টর ইসলামী সংগঠন নয় এবং ভারতের ব্যাপারে তাদের মনোভাবেও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে অশোক সজ্জনহার বলেন, ২০১৮ সালের নভেম্বরে যখন রাশিয়া তালেবানের কয়েকজন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানায়, তখনো পর্যবেক্ষক হিসেবে সেখানে দুজন সাবেক ভারতীয় কূটনীতিকের উপস্থিতি তালেবান মেনে নিয়েছিল।
অশোক সজ্জনহার বলেন, ‘১৯৯০-এর দশকের তালেবান আর এখনকার তালেবান এক নয়। তারা ইসলামী রাষ্ট্র চায়, কিন্তু একই সঙ্গে সেখানে সবার অংশগ্রহণে তাদের ততটা আপত্তি এখন আর নেই। তারা জানে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি তাদের প্রয়োজন।’
তা ছাড়া অশোক সজ্জনহার মনে করেন, সাধারণ আফগান জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি মনোভাব ইতিবাচক।
অশোক সজ্জনহার বলেন, ‘তারা জানে, ভারত যেভাবে তাদের সাহায্য করছে, সেটা আর কেউ করবে না। ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক না কেন, এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারবে না।’
তবে শুধু তালেবান বা পাকিস্তান নয়, আফগানিস্তানের ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের আগ্রহ যেভাবে বাড়ছে, সেটিও ভারতের মাথাব্যথার আরেকটি কারণ। চীন সম্প্রতি আফগানিস্তানের তামা ও লোহার খনিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। চীন ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাহায্য নিয়ে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে পারে—এ আশঙ্কাও ভারতের মধ্যে রয়েছে।
দোহার বৈঠকে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে মীমাংসা হবেই, তা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, মার্কিন নির্বাচনের আগে হয়তো একটি লোক দেখানো নাটক হচ্ছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আজ হোক বা কাল হোক, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবেই এবং তখন যে আফগানিস্তান অনেকটাই বদলে যাবে, তা নিয়ে কারোরই তেমন সন্দেহ নেই। সে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান।