অজানা রোগে ভুগছেন তরুণী, ৭ বছরে ৬৬ বার অস্ত্রোপচার
যুক্তরাজ্যের শার্লট এভান্সের বয়স যখন ১২, তখন হঠাৎ করেই তার শরীরের কোনো কোনো অংশ ফুলে যেতে শুরু করে। আর এ ফোলা ভাব থাকে মাসের পর মাস। এখন শার্লটের বয়স ১৯ বছর। এরই মধ্যে শার্লটকে শরীরের ফুলে যাওয়া অংশের চিকিৎসা করাতে ৬৬ বার ছুরি-কাঁচির নিচে যেতে হয়েছে। একবার তো এমন অবস্থা হয়েছিল যে শার্লটের একটি পা কেটে বাদ দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যের এ কিশোরীর অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে।
সমস্যার শুরু যেভাবে
শার্লট এভান্স বলেন, ‘ছোটবেলায় আমার কোনো সমস্যাই ছিল না। আমি নাচতে ভালোবাসি। প্রায় প্রতিদিনই আমি নাচতাম। থিয়েটারেও নাচের অনুষ্ঠান করতাম। হঠাৎ করেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।’
“একদিন নিতম্বে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ঘুম ভেঙে যায়। নিতম্বের ভেতরের দিকে শক্ত কিছু একটা অনুভব করি। ব্যথা বাড়তে থাকলে হাসপাতালে যাই। সেখানে একসময় টের পাই আমার সব আঙুল ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চিকিৎসকরা এটা দেখে বলেন, আমার ‘কম্পার্টমেন্ট সিনড্রোম’ হয়েছে। এ সম্পর্কে ডাক্তাররা জানান, সাধারণত শরীরে ব্যথা পেলে এটা হয়। কিন্তু আমার কেন এমনটা হচ্ছে, সে ব্যাপারে তাঁরা কোনো কারণ দেখাতে পারেননি”, যোগ করেন শার্লট।
হাত ও পায়ের মাংসপেশিগুলো বিশেষ কিছু জায়গায় ‘ফ্যাসিয়া’ নামে এক ধরনের কোষ দিয়ে আটকানো থাকে। এই জায়গাগুলোকে বলে ‘কম্পার্টমেন্ট’। কোনো কারণে এই কম্পার্টমেন্টের ওপর চাপ বেড়ে গেলে ‘অ্যাকিউট কম্পার্টমেন্ট সিনড্রোম’ দেখা দেয়। হাসপাতালে ফ্যাসিওটমির মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়। মূলত আক্রান্ত জায়গাটিতে কেটে ফুটো করে চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়।
শার্লট বলেন, ‘একপর্যায়ে আমার শরীরে প্রথমবার অস্ত্রোপচার করা হয়। চিকিৎসকরা আমার মাংসপেশি কেটে ফুটো করেন; এবং কয়েক দিন ধরে সেই ফুটো খোলা রাখা হয়। এরপর চাপ কমে গেল সেই কাটা জায়গা জুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই অস্ত্রোপচারের পর থেকে আমার সমস্যাও বাড়তে থাকে।’
শার্লট বলেন, ‘হাসপাতালের শিশু বিভাগে যে সময়টুকু ছিলাম, তখন মনে হতো চিকিৎসকরা আমার জন্য তেমন কিছু করছেন না। এরপর চিকিৎসকরা আমাকে বলতে থাকলেন, আমার আসলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তখনো আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা বারবার ফুলে উঠছিল।’
এভাবেই শার্লটের নিয়মিত চিকিৎসা চলতে থাকে। এরপর ২০১৯ সালের মার্চ মাসে শার্লটের পা আবার ফুলে যায়। নিয়মিত চিকিৎসার জন্য তিনি আবার হাসপাতালে ভর্তি হন।
শার্লট বলেন, “একদিন একজন চিকিৎসক আমার শয্যার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলেন, আমি কেমন আছি। উত্তরে আমি চাদর সরিয়ে বললাম, ‘আমার পায়ের অবস্থা এ রকম। পায়ে কোনো পালস নেই।’”
শার্লটের অবস্থা দেখে ওই চিকিৎসক জানালেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে।
শার্লট বলেন, ‘ওই চিকিৎসক বললেন, আমার পায়ের রং কালো হয়ে গেছে। তাই পা-টি কেটে ফেলতে হবে। এরপর আমাকে অচেতন করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ভেবেছিলাম, জ্ঞান ফেরার পর আমি আর পা দেখতে পাব না। কিন্তু জ্ঞান ফিরে দেখি পা জায়গামতোই আছে। আমি তো দেখে খুব খুশি।’
‘চিকিৎসকরা আমাকে জানালেন, পায়ের পালস ফিরে এসেছিল বলে তাঁরা পা কেটে বাদ দেননি। আর এক ঘণ্টা দেরি হলে পা-টা কেটেই ফেলতে হতো।’
শার্লট জানান, এ বছর মোট আটবার তাঁর শরীরের কোনো না কোনো অংশ ফুলে গিয়েছিল। একই সঙ্গে অন্যান্য সমস্যাও বাড়ছে। বয়স কম থাকলে ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত। এখন শুকোতে সময় বেশি লাগছে।
শার্লট বলেন, ‘এখন আমার নতুন চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এই প্রথম নতুন ওষুধে কিছু ফল হচ্ছে। ফুলে যাওয়ার ঘটনাও আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে।’
কিন্তু শার্লটের সমস্যাটা ঠিক কোথায়, তা চিকিৎসকরা এখনো ধরতে পারছেন না। এমনকি শার্লটকে দেওয়া নতুন ওষুধ কেন ও কীভাবে কাজ করছে, তাঁরা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে পারছেন না।
তবে পরিস্থিতির সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন শার্লট।
শার্লট বলেন, ‘ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পেরেছি যে দুনিয়ায় অনেক মানুষ আছে, যাদের রোগের কারণ জানা যায় না। এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। অনেক সময় আমার সমস্যার কথা চিকিৎসকরা বিশ্বাসও করতে চান না। তখন রাগ লাগলেও সেটা দমন করতে হয়; নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। কারণ, সেটা না করলে তাঁরা (চিকিৎসকরা) হয়তো বলবেন, আমার মানসিক চাপই এ রোগের কারণ।’
নাচতে না পারা নিয়েও দুঃখ রয়েছে শার্লটের। তিনি বলেন, ‘আমি থিয়েটারে অভিনয় করতাম, গান করতাম, নাচ করতাম। এখন আবার নাচের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছি। কিন্তু ভয় কাটছে না। কী জানি, যদি আবার সমস্যা শুরু হয়! তাই খুব একটা ভরসা পাই না। কিন্তু তবুও আমি আশায় বুক বেঁধে আছি—হয়তো একদিন আমি সেরে উঠব।