ভিয়েতনাম

চু চি টানেলে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস

Looks like you've blocked notifications!

‘কি এত নাম? ভিয়েতনাম!’ কবিতার লাইন বোধহয়। ২০১৭ সালে ভিয়েতনাম যাবার আগে ভিয়েতনাম নিয়ে অল্প কিছু পড়াশুনা করার সময় এই লাইনটার সঙ্গে পরিচিত হই। কার লেখা, কোথায় পড়েছি মনে নেই, শুধু লাইনটি মনে আছে।

ভিয়েতনাম যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল একটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে বক্তা হিসেবে যোগ দেবার সুবাদে । সেটি ছিল হ্যানয় শহরে । ভিয়েতনামে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ হা লং বে কিন্তু আমি মনে করি ভিয়েতনাম ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি হো চি মিন শহর দেখা না হয়। কারণ ভিয়েতনামের সঙ্গে ব্যক্তি হো চি মিন ও শহর হো চি মিন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ।

এই সরু ফাঁদে একজন লোক কীভাবে বসে থাকতে পারে? ছবি : লেখক

হ্যানয় থেকে হো চি মিন বাস , বিমান ও ট্রেনে যাওয়া যায়। বাসে ও ট্রেনে যেতে বেশ সময় লাগে, মানে প্রায় একদিন । একা থাকার কারণে আমি বিমানে হো চি মিন রওনা দেই। তবে একটি দেশকে ভালোভাবে জানা ও বোঝার জন্য বাস ও ট্রেন ভ্রমণ বেশ সহায়তা করে বলে আমি মনে করি। বিমানে হো চি মিন শহরে পৌঁছাতে সময় লাগে ৯০ মিনিটের মতো।

হো চি মিন শহরে যাবার মূল উদ্দেশ্য ছিল ওয়ার মিউজিয়াম এবং চু চি টানেল দেখা। হোটেলে পৌঁছে দেরি না করে বসে গেলাম পরের দিন চু চি টানেল দেখার প্ল্যান নিয়ে । হোটেল থেকেই বন্দোবস্ত করলাম ট্যুরের।

চু চি টানেলের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাপ করার আগে ব্যক্তি হো চি মিন সম্পর্কে দু-একটি কথা বলছি। হো চি মিন শব্দের অর্থ আলোর দিশারী। আংকেল হো, ভালোবেসে তাকে এই নামেই ডাকে ভিয়েতনামের আবাল- বৃদ্ধ-বনিতা । ছোটবেলায় তার নাম ছিল নগুয়েন। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য তিনি ‘ভিয়েত মিন’ নামে গেরিলা সংগঠন তৈরি করেন। ভিয়েতনামে আমি নয়দিন ছিলাম সেখানে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলার সময় আমি লক্ষ্য করেছি তারা খুব গর্ব করে হো চি মিন নামটি উচ্চারণ করেন। ভিয়েতনামের তরুণ সমাজের জন্য হো চি মিন একটি উদ্দীপনার নাম।

গাইড ফাঁদের বর্ণনা করছে। ছবি : লেখক

যেমন কথা ছিল, ঠিক সকাল ৮টায় আমার গাড়ি এসে হাজির আমাকে নেওয়ার জন্য। হোটেলের রিসিপশনে এক তরুণ হ্যান্ডশেক করে গাড়িতে উঠতে বলল। গাড়িতে উঠে দেখলাম আরো চারজন রয়েছে, বিভিন্ন হোটেল থেকে এক জায়গায় জড়ো হয়ে আমরা সকলে মিলে যাত্রা করলাম চু চি টানেল দেখার জন্য। এভাবে প্যাকেজ নিয়ে গেলে খরচ অনেক কম পড়ে। গাড়িতে উঠে বুঝলাম যে তরুণ আমাকে রিসিভ করেছে সে হচ্ছে আমাদের গাইড। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে গন্তব্যে এসে উপস্থিত হলাম। শুধু গাড়ির প্যাকেজ নয়, মোটরবাইক ভাড়া করেও চু চি টানেলে যাওয়া যায়। আমার প্যাকেজটি ছিল প্রবেশ টিকেট ও দুপুরের খাবারসহ।

গাড়ি একটি নিদিষ্ট জায়গায় রেখে গাইডকে অনুসরণ করলাম। ১০-১২ কদম হাঁটার পর দেখতে পেলাম মাটির তিন-চারটা ঘর যার ছাদ করা হয়েছে এক বিশেষ ধরনের পাতা দিয়ে।

লড়াই করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার দৃষ্টান্ত সৃষ্টির নাম ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ দুনিয়ার শোষিত নিপীড়িত মানুষের কাছে এক অসামান্য উদাহরণের নাম। আমি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু চু চি টানেলের পথ ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় কল্পনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেখতে পাচ্ছিলাম ।

টানেলে প্রবেশের মুখ। ছবি : লেখক

চু চি টান্যাল কী?

চু চি, হো চি মিন শহর থেকে ৬০ কিলমিটার দূরে একটি জেলার নাম। এই চু চি জেলাতেই সেই বিশাল টানেলটি মাটির নিচে অবস্থিত, যা কম্বোডিয়ার বর্ডার পর্যন্ত বিস্তৃত। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেই টানেলে ছিল ভিয়েতনাম গেরিলাদের থাকার জায়গা, বাঙ্কার , পরিখা এবং বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ।  

আমাদের গাইডের ভাষ্য মতে, এটি বানাতে সময় লেগেছে ২৫ বছর। ‘ভিয়েত মিন’ গেরিলা বাহিনী এটি বানানো শুরু করে ১৯৪৮ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে। আমেরিকার সাথে যুদ্ধের সময় চু চি টানেলের আয়তন ছিল ২৫০ কিলোমিটার। সৈন্যদের সেখানে রান্না, খাওয়া দাওয়া, বাসস্থান, এমনকি বিনোদনের জন্য সিনেমা হল পর্যন্ত ছিল।

এই ট্যানেলের কিছু booby traps (বোকা ফাঁদ ) ছিল যার দরুণ আমেরিকার সৈন্যরা সহজেই কুপোকাত হতো। এই ফাঁদগুলো থেকে বাঁচার জন্য, তারা জার্মান কুকুর দিয়ে ভিয়েতনামের গেরিলাদের ধরার চেষ্টা করত, কিন্তু ভিয়েতনামী গেরিলা বাহিনী আমেরিকান সেনাদের সাবান ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষা করত। কয়েকটি ফাঁদ সম্পর্কে গাইড আমাদের বর্ণনা করল যেমন- রোলিং ট্র্যাপ, ফিশ ট্র্যাপ, উইন্ডো ট্র্যাপ।

যুদ্ধ কামানের সামনে। ছবি : লেখক

চু চি টানেল ভিয়েতনামের স্বাধীনতার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । এই টানেলকে যুদ্ধ জয়ের অন্যতম হাতিয়ার মনে করা হয়। টানেলের রাস্তাগুলো এতই সরু যে একজন কোনো রকমে সেখানে প্রবেশ করতে পারে। সবগুলোতে পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি নেই। যেগুলোতে আছে আমি সবগুলোর ভেতরে প্রবেশ করেছি।

ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম একটি জায়গায় কিছু জুতো ঝুলছে, গাইড আমাদের বর্ণনা করলেন গেরিলারা টায়ার কেটে এক ধরনের জুতা বানাত যা কাঁদা মাটিতে চলতে সহায়ক হতো।

টায়ার দিয়ে বানানো জুতা। ছবি : লেখক 

কিছুদুর হাঁটতে হাঁটতে গাইড একটি বসার জায়গা দেখিয়ে বসতে বলে একটি প্লেটে করে লম্বা আলুর মতো একটি সবজি আমাদের খেতে দিল লবণ দিয়ে এবং সঙ্গে এক ধরনের চা। লম্বা আলুর মতো সবজিটা আমার কাছে আমাদের দেশের মিস্টি আলুর মতো লাগছিল খেতে, তবে তাতে মিস্টি নেই। ভিয়েতনাম গেরিলা বাহিনীর খাবারের অভাব হলে তারা এই সবজি ও চা খেত।

যুদ্ধ চলাকালীন খাবার। ছবি : লেখক

পর্যটকদের জন্য যুদ্ধের ইতিহাসের এমন সুন্দর উপস্থাপন করার বিষয়টি আমি ভিয়েতনামে গিয়েই প্রথম পেয়েছি। এভাবে আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধকেও বিদেশিদের কাছে তুলে ধরা যেতে পারে।

গাইডের বর্ণনা আর পুরো জায়গাটি ঘুরে দেখতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগল। ফেরার সময় গাড়িতে বসে বসে আমি চু চি টানেলের সরু পথের তাজা স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে করতে হোটেলে ফিরলাম।