শীতে ছুটিতে
ময়নামতি জাদুঘরে একদিন
বাংলাদেশের অন্যতম এক জেলা কুমিল্লা। এখানে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখা যায়। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।
কুমিল্লার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে ময়নামতি জাদুঘর দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকষণীয় স্থান। এ জাদুঘর এখন শুধু ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো নয় বরং শিক্ষার্থী, পর্যটক, তথা দেশি-বিদেশি গবেষকদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ময়নামতি জাদুঘরটি শিক্ষার পাশাপাশি একইসাথে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই দেখা যায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম।
ময়নামতি জাদুঘর ১৯৬৬ সালের ১২ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। কুমিল্লার শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, শ্রীভবদের মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবানমুড়া, ইটাখোলা মুড়া, রানির বাংলা, ভোজ বিহারসহ বিভিন্ন বিহার খননকালে পুরোনো দিনের অনেক মূল্যবান পুরাসামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়। এসব পুরাবস্তু সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্যই শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে শালবনকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়।
জাদুঘরের প্রবেশপথের বাঁ পাশেই রয়েছে গৌতম বুদ্ধের বিশালাকার একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি। তার পরই রয়েছে বেলে পাথরে দণ্ডায়মান বৌদ্ধের মূর্তি যা আনুমানিক সপ্তম শতকের দিকে তৈরি। ১২-১৩ শতকের দুটো তাম্র শাসনের পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
জাদুঘরের প্রবেশ পথের বাম দিকে থেকে ১নং খোপে রাখা নিদর্শন দিয়ে প্রদর্শনী আরম্ভ করে ক্রমান্বয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে প্রবেশ দ্বারের ডান দিকে ৪২ নং প্রদর্শনীতে এসে শেষ হয়েছে।
ভবনের উত্তর দিকে পরিসর বাড়িয়ে আরো ২১টি আধার সংযুক্ত করা হয়েছে। যেগুলোতে এখনো কোনো প্রদর্শনী বস্তু রাখা হয়নি। প্রদর্শনী আধারগুলোতে প্রত্মতাত্ত্বিক স্থান খননের উম্মোচিত স্থাপত্যসমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষের ভূমি-নকশা, প্রাচীন মুদ্রা, পোড়া মাটির ফলক, ধাতুলিপি ফলক, মৃন্ময় মুদ্রক-মুদ্রিকা, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পাথরের মূর্তি, কাঠের মূর্তি, লোহার পেরেক, পাথরের গুটিকা, অলংকারের অংশ, ঘরে ব্যবহৃত মাটির হাড়ি-পাতিলসহ প্রাচীনকালে ব্যবহৃত তৈজসপত্র সংরক্ষিত রয়েছে।
এ ছাড়া আধারের ফাঁকে ফাঁকে মেঝের ওপর জাদুঘর ভবনের বিভিন্ন স্থানে কিছু পাথর এবং ব্রোঞ্জ মূর্তিও প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। এসব মূর্তির কয়েকটি প্রাচীন সমতটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত। জাদুঘরে প্রদর্শনের উল্লেখযোগ্য পাথর ও ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পাথরের দণ্ডায়মান লোকোত্তর বুদ্ধ মূর্তি, ত্রি বিক্রম বিষ্ণুমূর্তি, তারা মূর্তি, মারীছী মূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, পার্বতী মূর্তি, হরগৌরী মূর্তি, নন্দী মূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, মনসা মূর্তি, গণেশ মূর্তি, সূর্যমূর্তি, হেরচক মূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ্রসত্ত্ব মূর্তি অন্যতম। এ ছাড়া ছোট-বড় আকারের ব্রোঞ্জের ও মাটির তৈরি মূর্তি রয়েছে।
এ জাদুঘরে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরি বিশালাকায় একটি ঘণ্টা। যার ওজন আনুমানিক ৩৭০ কেজি। এর ব্যাস ৮৪ সেন্টিমিটার এর উপরের বেড়িসহ উচ্চতা ৭৩ সেন্টিমিটার। এ জাদুঘরের আধারে সুরক্ষিত রয়েছে ময়নামতিতে পাওয়া প্রাচীনকালের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ ও তামার তৈরি সামগ্রী, লোহার তৈরি সামগ্রী, মাটির তৈরি বিভিন্ন প্রকারের খেলনা, কাঠের কাজের নিদর্শন, তুলট কাগজে লেখা প্রাচীন হস্তলিপির পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন নমুনার মৃৎপাত্র প্রভৃতি।
ময়নামতি জাদুঘর পরিদর্শনের সময়সূচি :
ময়নামতি প্রত্মতাত্ত্বিক জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য প্রতি সপ্তাহে শনিবার ব্যতীত অপর ছয়দিন খোলা থাকে। এ ছাড়া সপ্তাহের প্রতি রোববার ও সোমবার অর্ধ দিবস সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে। মধ্যাহ্ন বিরতি হলো দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বিরতি। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রমজানে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রদর্শনের সময়। মধ্যহ্ন বিরতি ১টা থেকে দুপুর ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। এ ছাড়া জাদুঘরটি সরকারের অন্যান্য নির্বাহী আদেশে ঘোষিত সব ছুটির দিনেও বন্ধ থাকে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ ও কমলাপুর হতে বেশ কয়েকটি ভালোমানের বাস পাওয়া যায়। কুমিল্লা পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। এ ছাড়া কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ট্রেনেও আসা সহজ। ঢাকা থেকে কুমিল্লার দূরত্ব ৯৫ কিলোমিটার।
ঢাকা থেকে বাসে আসতে হলে সায়েদাবাদ থেকে এশিয়া ট্রান্সপোর্ট, এশিয়া লাইন বা তিশা ট্রান্সপোর্ট (এসি, নন-এসি উভয়ই রয়েছে), কমলাপুর থেকে রয়েল কোচ এসিতে করে আসতে পারেন। বাসে আসলে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অথবা কোটবাড়ি বিশ্বরোড নেমে যাবেন। ভাড়া নেবে ১৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়ে কোটবাড়ি যাওয়ার বাস (ভাড়া ১৬ টাকা) অথবা কোটবাড়ি বিশ্বরোডে থেকে কোটবাড়ি যেতে সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ১০ টাকা।
চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে কুমিল্লা আসতে সৌদিয়া ট্রান্সপোর্টে (এসি, নন-এসি) চড়ে আসবেন কুমিল্লার পাদুয়ার বাজার বিশ্বরোড দিয়ে জাঙ্গালিয়া নেমে যাবেন, ভাড়া নেবে ২০০-৩০০ টাকা। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। জাঙ্গালিয়া নেমে টমছমব্রিজ অটোতে করে পাঁচ টাকা নিবে। কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা বাইপাস নন্দনপুর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি জাদুঘর। সিএনজিচালত রিকশা/ইজিবাইকে করে কোটবাড়ি থেকে ময়নামতি জাদুঘরে জনপ্রতি ভাড়া ১০ টাকা।
যেখানে থাকবেন
কুমিল্লা এসে থাকতে পারেন, বেশ কয়েকটি ভালোমানের হোটেল আছে এখানে। তা ছাড়া বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে (বার্ড) পরিচিত কেউ থাকলে বা আগে যোগাযোগ করে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন।