বাংলাদেশে ফুটবল বিশ্বকাপ : সমর্থন নাকি উগ্রতা?
বিশ্বকাপের মঞ্চ প্রস্তুত। প্রস্তুত ৩২টি দেশ। সেরাদের লড়াইয়ে নিজেদের রণকৌশল প্রদর্শনের জন্য উন্মুখ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব টপকাতে পারা সৌভাগ্যবান দেশের খেলোয়াড়রাও। বিশ্বকাপ-জ্বরের উত্তাপে পুড়ছে বিভিন্ন দেশের ভক্ত ও সমর্থকরা। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর তুলনায় তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশে বিশ্বকাপ উত্তেজনা যেন একটু বেশিই। ২১১টি দেশের মধ্যে ফিফা র্যাংকিংয়ে ১৯৪তম স্থানে থাকা দেশটির ফুটবল উত্তেজনা যেন একটু অস্বাভাবিকই। সবকিছু ছাপিয়ে ব্রাজিল- আর্জেন্টিনার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমর্থনকে ছাপিয়ে হিংসাত্মক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ বিশ্বকাপে কখনো খেলার যোগ্যতা অর্জন করেনি। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে খেলার কোনো সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু এ দেশের মানুষ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করাটা প্রায় পাগলামির পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। গত সপ্তাহে পুলিশের বরাত দিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের বান্দার উপজেলায় আর্জেন্টিনার তারকা লিওনেল মেসি ও ব্রাজিলের তারকা নেইমারকে নিয়ে ঝগড়ার একপর্যায়ে ধারালো ছুরির আঘাতে বাবার মৃত্যু ও ছেলে গুরুতর আহত হয়েছে। এরই মধ্যে ১২ বছর বয়সী একজন কিশোর ব্রাজিলের পতাকা রাস্তার পাশের খাম্বায় লাগাতে গিয়ে ইলেকট্রিক শকে মৃত্যুবরণ করে। জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় শ’খানেক মোটরসাইকেলে চড়ে ব্যানার নিয়ে মিছিল করে ফুটবলপ্রেমীরা। এমনকি তারা সভার মাধ্যমে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর কোন কোন উপায়ে নিজেদের ‘পিওর’ ফুটবলপ্রেমী হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।
ফুটবলপ্রেমীদের উত্তেজনা ছাড়িয়ে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে শুধু ফুটবলকে কেন্দ্র করে আঘাত করতেও পিছপা হচ্ছে না। একজন আইনজীবী কোর্ট অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশে অন্য কোনো দেশের পতাকা ওড়ানো বন্ধ করার জন্য রিট করেছিলেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাত হাজার সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর ক্যাম্পাসে অন্য কোনো দেশের পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর এস. এম. ইমামুল হক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের উচিত সারা দেশে বিদেশি পতাকা ওড়ানো বন্ধ করা।’
বাংলাদেশে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা দলকে সমর্থন করা একটা ঐতিহ্যগত ব্যাপার। সেলেসাওদের দলটি কিংবদন্তিদের দিয়ে ঠাসা। পেলে, রোনালদোদের খেলা দেখে বেড়ে ওঠা মানুষদের এসব দলের প্রতি আগ্রহ জন্মে সময়ের ওই সব তারকার ফুটবল রণকৌশলে মুগ্ধ হয়ে। অন্যদিকে, দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলীয় দ্বন্দ্ব জমে ওঠে ১৯৮৬ সালে দিয়েগো ম্যারাডোনার হাত ধরে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ঘরে তুললে। মূলত ম্যারাডোনার একক কৃতিত্বে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দারুণ সাফল্য পাওয়ায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বন্দ্ব আবার চাঙ্গা দিয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের এই ‘ক্রেজকে’ সমাজবিজ্ঞানীরা কীভাবে দেখছেন? সমাজবিজ্ঞানীদের চোখে সমর্থকদের সমর্থনের নামে উগ্র আচরণকে ‘ছোট মন মানসিকতার পরিচয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগটির চেয়ারম্যান ড. নেহাল করিম বলেন, ‘সমর্থকদের অধিকাংশই জানে না ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দেশের অবস্থান কোথায়। এমনকি তাদের মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্ক কিংবা ভাষাগত সামঞ্জস্য নেই। কিন্তু তারা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বলতে পাগল। আমি আদৌ এর কারণ খুঁজে পাই না।’