গ্রেগ চ্যাপেলে বিধ্বস্ত ভারত ও পাকিস্তান
গ্রিগোরি স্টিফেন চ্যাপেল। নামটা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিতর্কিত এক মানুষের মুখ। ভারতীয় ক্রিকেটকে প্রায় ধ্বংসই করে ফেলেছিলেন এই অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোক। বেচারা সৌরভ গাঙ্গুলীর ক্যারিয়ারটাই তো শেষ হয়ে যায় তাঁর কারণে। শচীন টেন্ডুলকারের মতো স্বচ্ছ ইমেজের ক্রিকেটার পর্যন্ত তাঁকে 'রিং মাস্টার' বলে অভিহিত করেন। বলা হয়, ভারতীয় ক্রিকেটে সিনিয়র হটাও তত্ত্বের প্রবক্তাও এই গ্রেগ চ্যাপেল। শেষ পর্যন্ত তাঁকে হটাতে মৌন আন্দোলন পর্যন্ত করতে হয় ভারতীয় সিনিয়র ক্রিকেটারদের। এর পরই কোচিং ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় চ্যাপেলের। তবে কোচ হিসেবে যতই খারাপ হোক, ক্রিকেটার হিসেবে কিন্তু দুর্দান্ত ছিলেন এই অসি অলরাউন্ডার। ৮৭ টেস্টে ৫৩.৮৬ গড়ে করেছেন ৭,১১০ রান। ২৪ শতকের সঙ্গে ৩১ অর্ধশতক আর ৭৪ ওয়ানডেতে ৪০ গড়ে ২,৩৩১ রানের সঙ্গে ৭২ উইকেট কিন্তু সে কথাই বলে। বিতর্কিত এই চরিত্র নিয়ে আজকের আলোচনাটা কিন্তু তাঁর ক্রিকেটীয় কীর্তির কারণেই।
৮ জানুয়ারি। ১৯৭৩ সালের আজকের দিনে বল হাতে একাই পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দেন চ্যাপেল। আর ১৯৮১ সালের এই তারিখে বল হাতে ভারতকেও ধসিয়ে দেন তিনি। কাকতালীয়ভাবে উভয় ফরম্যাটে চ্যাপেলের ক্যারিয়ার-সেরা বোলিং ফিগারটা এসেছে একই তারিখে! ১৯৭৪ সালে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬১ রানে ৫ উইকেট তুলে নেন তিনি।
ম্যাচের তৃতীয় দিন। অস্ট্রেলিয়ার ৩০৬ রানের জবাবে ৪ উইকেটে ২৫০ রান তুলে শক্ত অবস্থানে সফরকারী পাকিস্তান। মুশতাক মোহাম্মদ ৬৯ ও আফিস ইকবাল ৪৭ রানে অপরাজিত। দিনের শুরুতেই আসিফকে ফিরিয়ে দেন চ্যাপেল। অপর প্রান্তে মুশতাক সেঞ্চুরি করলেও ইনিংসের লাগামটা টেনে ধরেন অসি অলরাউন্ডার। শেষ পর্যন্ত ৩৬০ রানে অলআইট হয় পাকিস্তান। সেলিম আলতাফ ও সরফরাজ নওয়াজের বোলিং তোপে দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮৪ রানেই শেষ ইয়ান চ্যাপেলদের ইনিংস। ১৫৭ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ডেনিশ লিলি ও ম্যাক্স ওয়াকারের বিধ্বংসী বোলিংয়ে ১০৬ রানে অলআউট হয় পাকিস্তান। ৫২ রানে ম্যাচ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। গ্রেগ চ্যাপেলের নৈপুণ্যে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজও জেতে স্বাগতিকরা। সিরিজে ৬০ গড়ে ২৪২ রান করেন গ্রেগ।
সে ঘটনার আট বছর পর সেই সিডনিতে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামে অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়া। বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিরিজের দ্বিতীয় টুর্নামেন্ট সেটি। ব্যাটে-বলে আবারও জ্বলে উঠলেন গ্রেগ চ্যাপেল। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা ভারতকে পেস দিয়ে নাজেহাল করে তোলেন গ্রেগ। মাত্র ১৫ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে গাভাস্কার-কপিল দেবদের ৬৩ রানে অলআউট করে দেয় অস্ট্রেলিয়া। কেবল এখানেই থামেননি তিনি। ব্যাট হাতে ৩৩ রান করে ভারতের কফিনে শেষ পেরেকটিও মারেন গ্রেগ চ্যাপেল। সেবার নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জেতে তাঁর দল। সিরিজে ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ ৬৮৬ রান করেন গ্রেগ চ্যাপেল।
সাত বছর তাঁর নেতৃত্বে খেলে অস্ট্রেলিয়া। প্রথমবার ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। অধিনায়ক হিসেবে খেলে ৪৮ টেস্টে ২১টিতে জয় পান চ্যাপেল। ১৩ হারের বিপক্ষে ড্র হয়েছে ১৪টি টেস্ট। কাকতালীয়ভাবে তাঁর নেতৃত্বে ৪৯ ম্যাচে ২১টিতেই জেতে অসিরা। হার ২৫ ম্যাচে।
বর্ণময় জীবনে অনেক বিতর্কের সঙ্গী ছিলেন গ্রেগ। ১৯৮১ সালে আন্ডারআর্ম ঘটনার অন্যতম খলনায়ক তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া শিরোপা জিতলেও স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৫০ হাজার দর্শক ধিক্কার জানায় চ্যাপেলদের। ২০০৫ সালে ভারতীয় দলের কোচ হন তিনি। সেখানেও সিরিজ বিতর্ক ও ব্যক্তিত্বের সংঘাতের মুখে পড়েন সাবেক এই অসি অধিনায়ক। শচীন টেন্ডুলকার তাঁর আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ বইয়ে গ্রেগ চ্যাপেলকে ‘রিং মাস্টার’ উল্লেখ করে লিটল মাস্টার বলেন, 'ভারতীয় ক্রিকেটকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে তোলা ছাড়া চ্যাপেল-জমানার আর অন্য কোনো অবদান ছিল না।'