বিকাশের যন্ত্রণায় শরিক হবেন শচীন-সৌরভ
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট খেলেই বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। সেই যন্ত্রণা এখনো তাড়া করে বিকাশ রঞ্জন দাসকে। চোট আর বোর্ডের অবহেলায় হারিয়ে যাওয়া এই ক্রিকেটার থাকবেন ইডেন গর্ডেনসে ঐতিহাসিক টেস্টে।
ইডেনে সংবর্ধনা নিতে কলকাতা যাওয়ার আগে পুরোনো স্মৃতি মনে করে বিকাশ বলেন, ‘যখনই ভাবতাম সৌরভ-শচীনকে বল করব, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সত্যি কথা বলতে ভীষণ রোমাঞ্চিত ছিলাম। রমেশকে বোল্ড করলাম। প্রথম ইনিংসে আমরা ভালো করলাম। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসের কারণে ম্যাচটা আর পাঁচদিনে টেনে নিয়ে যেতে পারিনি।’
সেই অভিষেক টেস্ট খেলা বাংলাদেশের স্বপ্নের নায়কদের ইডেন গার্ডেনসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর অভিষেক টেস্ট খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে। সেই দলটিতে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে ইডেনের গোলাপি বলের টেস্ট দেখতে আমন্ত্রণ জানায় বিসিসিআই সভাপতি। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে অন্যরকম অভিষেক হয়েছিল ‘প্রিন্স অব কলকাতা’র। সেই ম্যাচ থেকেই ভারতীয় দলের নেতৃত্বের অভিষেক হয় সৌরভের। যে কারণেই বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টটা তাঁর কাছেও স্মরণীয়। জাতীয় দলের সাবেক সতীর্থদের সঙ্গেই ইডেনে সংবর্ধনা নিতে যাবেন বিকাশ (বর্তমান নাম মাহমুদুল হাসান)।
সেই ম্যাচের কথা স্মরণ করে এই সাবেক পেসার বলেন, ‘সেই স্বপ্নস্মৃতি ভোলা যায় না। সবই তো মনে পড়ে। শান্ত ভাই (হাসিবুল হোসেন শান্ত) প্রথম ওভার করেছিলেন। অন্য প্রান্ত থেকে শুরু করেছিলাম আমি। প্রথম বলটা করেছিলাম সদাগোপান রমেশকে।’
বিকাশ হতে পারতেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বোলার। সেই সম্ভাবনা ছিলও। ১৮ বছরের গণ্ডি না পেরোতেই বাংলাদেশের হয়ে খেলেন অভিষেক টেস্ট। কিন্তু ঝরে পড়েছিলেন। অভিষেক টেস্টই যে হয়েছিল তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। প্রথম টেস্ট খেলার পরই দলের বাইরে চলে যান তিনি। তারপর ২০০৪ সাল অবধি ঘরোয়া ক্রিকেট খেললেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে আর দেখা যায়নি তাঁকে।
প্রথম টেস্টের পরই চোট। তার পরই অনেকটাই আড়ালে চলে যান তিনি। তাই আক্ষেপ করে বলেন, ‘বল করার পর পিঠে প্রচুর ব্যথা হতো। তা অসহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা মানসিকভাবে আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ক্রিকেট ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। সেই সময় বোর্ডের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। সেখান থেকেও কোনোরকম সহযোগিতা পাইনি। পেলে হয়তো অকালেই বিদায় জানাতে হতো না ২২ গজকে।’
অকাল বার্ধক্যের সেই ক্ষত বুকে নিয়েই এই সাবেক ক্রিকেটার বলেন, ‘আমার বয়স তখন খুবই কম। ভীষণই অপরিণত ছিলাম। আধুনিক ক্রিকেটের মতো এত জৌলুস, চাকচিক্যও ছিল না। প্রথম টেস্ট খেলার সময় থেকেই পিঠের ব্যথায় ভুগছিলাম। একজন পেস বোলারকে নিজের শরীরের যত্ন নিতে হয় সেটা বুঝতে পারিনি। জাতীয় দলের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটও চুটিয়ে খেলতাম। টানা বোলিং করে গেছি একনাগাড়ে। ওটাই আসলে আমার সর্বনাশ করেছে। অল্প বয়সের শরীর অতিরিক্ত ধকল নিতে পারেনি।’
চোট আর বোর্ডের অবহেলায় অভিমানে ক্রিকেটই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিকাশ রঞ্জন দাস। এরপর নিজের নামটাও বদল করে ফেলেছিলেন হঠাৎ। ছিলেন বিকাশ রঞ্জন দাস। হয়ে গিয়েছিলেন মাহমুদুল হাসান। জাতীয় দলের বোলিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার বদলে বিকাশ এখন ব্যাংকের ম্যানেজার। সামলাচ্ছেন ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল)-এর ঢাকার একটি শাখায় ম্যানেজারের দায়িত্ব।
ক্রিকেট ছাড়ার পর থমকে যাওয়া পড়শুনোয় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরিও পেয়ে গিয়েছিলেন বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডে (ইবিএল)। বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যান বিকাশ রঞ্জন দাস। স্মৃতির অতলে মুছে গিয়েছিলেন। বিকাশের কণ্ঠে আক্ষেপ, দুঃখ, যন্ত্রণা একাকার হয়ে যায়, “একবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলাম খেলার সূত্রে। সেখানে দেখা হয়েছিল শচীন তেন্ডুলকার ও অজিত আগারকারের সঙ্গে। তাদের দুজনকেই ভারতীয় বোর্ড পাঠিয়েছিল চিকিৎসা করাতে। আমার বেলায় সে রকম হয়নি। এই কষ্টটা আমার আছে। চিরদিনই থাকবে। এখন ব্যাংকে চাকরি করছি। আকরাম ভাই (আকরাম খান) মাঝেমধ্যে ব্যাংকে আসেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। দাদার (সৌরভ গাঙ্গুলি) আমন্ত্রণের কথা প্রথম জানিয়েছেন সুমন (হাবিবুল বাশার) ভাই।’
ইডেনে যখন তিনি সতীর্থদের সঙ্গে সংবর্ধনা নেবেন, ফেলে আসা সময়ও নিশ্চয় ভিড় করে আসবে। তাঁর সঙ্গেই একই মঞ্চে থাকবেন ক্রিকেট দুনিয়ার বরেণ্য ব্যক্তি, রথী-মহারথীরা। শচীন-সৌরভের সান্নিধ্যে ইডেনের উজ্জ্বল লাইম লাইটে কী যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হবে পদ্মাপাড়ের ট্র্যাজির নায়কের?