প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ফুটবল মঞ্চে এই পাকিস্তানি তরুণী
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ৫০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাকিস্তানের চিত্রাল উপত্যকা। যেখানে ইন্টারনেটের প্রসার তেমন নেই। নেই প্রযুক্তিগত সুবিধা। তেমন প্রত্যন্ত গ্রামেই বেড়ে উঠেছেন কারিশমা আলি, যিনি এখন একাধারে ফুটবল-টেনিস থেকে শুরু করে মাতাচ্ছেন ফ্যাশনমঞ্চ।
চিত্রাল উপত্যকার প্রথম নারী হিসেবে ফুটবল খেলেছেন কারিশমা। গত বছর টেনিসে এশিয়ান ফোর্বসের সেরা ৩০ জনের মধ্যে নাম লিখিয়েছেন তিনি। দুবাইতে জুবলি গেমসে পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পাকিস্তানের প্রথম নারী দল হিসেবে এএফএল আন্তর্জাতিক কাপে অংশ নিয়েছে কারিশমার দল। এরপর নিজের অঞ্চলের মেয়েদের ফুটবলের আলো দেখানোর জন্য মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন কারিশমা। ক্লাবটির নাম চিত্রাল মহিলা ক্রীড়া ক্লাব।
এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এতটা পথ কীভাবে এলেন এই পাকিস্তানি তরুণী? সেই গল্প শোনালেন তিনি নিজেই। সিএনএনকে দেওয়া ৪৫ মিনিটের লম্বা সাক্ষাৎকারে নিজের পথচলা ও স্বপ্ন তুলে ধরেন তিনি।
সিএনএন স্পোর্টসকে কারিশমা বলেন, ‘এ অঞ্চলের মেয়েদের সবারই আলাদা আলাদা স্বপ্ন আছে। কিন্তু সমাজের বাইরে গিয়ে আলাদা কিছু করা তাদের জন্য খুব কঠিন।’
মেয়েদের স্বপ্ন দেখাতে কারিশমা যে ক্লাব খুলেছে, তাতেও করোনার প্রভাব পড়েছে। কোভিডের কারণে সাময়িক বন্ধ হয়ে গেছে চিত্রাল মহিলা ক্রীড়া ক্লাব। তবে মেয়েদের খেলায় ফেরাতে দ্রুতই ক্লাব খুলতে যাচ্ছেন এই তরুণী, ‘অনেক কিছু করা দরকার। বিশেষ করে এই অঞ্চলের তরুণী, গৃহবধূদের জন্য আমি কাজ করতে চাই, যারা পরিবর্তন চায়।’
কারিশমার স্বপ্ন পূরণে বড় ভূমিকা রেখেছে তাঁর পরিবার। কারিশমার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেছেন তাঁর বাবা। কারিশমা বলেন, ‘আমার বাবার কারণে আমি আলাদা ছিলাম। এখানকার মেয়েরা একটু বড় হলে আর স্কুলে যেত না। গত বছর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, পাকিস্তানের পাঁচ মিলিয়ন শিশু প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে, যার মধ্যে বেশিরভাগ হলো মেয়ে। আমি যখন আট বছর বয়সী ছিলাম তখন ভাবতাম, এই সমাজের সবকিছু এত খারাপ যে পুরুষদের সঙ্গে মেয়েদের যেকোনো কাজের অনুমতি দেওয়া হয় না। যদিও বাইরে এসে কোনো নারীকে কিছু করতে দেখিনি। তবে নিশ্চিত ছিলাম, সুযোগ পেলে নারীরা কাজ করতে পারত।’
বাবার প্রশংসা করে কারিশমা আরো বলেন, ‘আমার বাবা সব সময় আমার মা, আমার বোন ও আমাকে উৎসাহ দিতেন। কখনোই কোনো কাজ করতে আমাদের বাধা দেননি।’
বাবার সঙ্গে টিভিতে ২০০৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপ দেখেছেন কারিশমা। সেখান থেকেই মূলত তাঁর ফুটবলপ্রেমের শুরু। কারিশমা বলেন, ‘সেই মুহূর্তে (২০০৬) আমার ফুটবলপ্রেম শুরু হয়। তখন আমি অনুভব করি, আমি খেলাটি খেলতে চাই। আমি খেলাটির প্রেমে পড়ি।’
নিজের ফুটবলপ্রেম নিয়ে কারিশমা বলেন, ‘আমি যখন ফুটবল মাঠে পা রাখি, তখন আমি জীবনের সব সমস্যা ভুলে যাই। তখন শুধু খেলাতে মনোযোগ দিই। এটা আমার কাছে অসাধারণ এক আনন্দ, যার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।’
বাবার সঙ্গে খেলা দেখার ১০ বছর পর আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান কারিশমা। প্রথম খেলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট করলে বাজে মন্তব্যের শিকার হন এই তরুণী।
পাকিস্তানি তরুণীর কথায়, ‘আমি কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতাম না। ফুটবল খেলি, এটাও কখনো বলতাম না। ২০১৬ সালে যখন আমি আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচিত হয়েছিলাম, তখন আমি একটি পোস্ট করেছি। যার শিরোনাম ছিল, কারিশমা আলি চিত্রালের প্রথম মেয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফুটবল খেলেছে। সেই পোস্টে আমি ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া পেলাম। কিছু মানুষ ভয়ংকর মন্তব্য করেন। আমাকে সরাসরি হুমকি দেওয়া হয়েছে। তখনই আমি আমার শিক্ষা পেয়েছি।’