সাক্ষাৎকার
‘আমার যে অভিষেক হচ্ছে সেটাই মনে ছিল না’
ভারতের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। তবে এই হতাশার মাঝেও একমাত্র আশার আলো হয়ে জ্বলেছেন বাংলাদেশ দলের উদীয়মান ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ নাঈম। তিন ম্যাচের সিরিজে এক অর্ধশতকসহ ১৪৩ রান নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছেন তরুণ এই ব্যাটসম্যান।
ভারতের বিপক্ষেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে নাঈমের। টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষে দেশে ফিরে এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানালেন নিজের অভিষেক ম্যাচের অনুভূতিসহ ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা।
প্রশ্ন : অভিষেকের আগের রাতের অনুভূতি কেমন ছিল?
মোহাম্মদ নাঈম : প্রথম টি-টোয়েন্টির আগের দিন মাহমুদউল্লাহ ভাই আমাকে ফোন দেন। বলেন, ‘আগামীকাল তোমার খেলতে হবে, তৈরি থাক।’ তো আমিও সেভাবেই তৈরি ছিলাম। মাঝে একটা টিম মিটিং ছিল, ঘুমের কারণে সেটা মিস করেছিলাম। তার পর মাহমুদউল্লাহ ভাই বলেন, ‘এগুলো নিয়ে কোনো চিন্তা করার দরকার নেই। যতটা পার একটু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা কর। ম্যাচের দিকে ফোকাস রাখ, ম্যাচ নিয়ে চিন্তা কর।’ আমিও ভাইয়ার কথা অনুযায়ী নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : আলাদা কোনো চিন্তা?
মোহাম্মদ নাঈম : না, অভিষেক ম্যাচ নিয়ে আলাদা কোনো চিন্তা আসেনি। আমি শুধু ঘরোয়া ক্রিকেটের মতো ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছি। ঘরোয়া লিগে যেভাবে খেলি, এখানেও একইভাবে খেলার চেষ্টা করেছি। তবে ফোকাসটা একটু বেশি ছিল, একটু বেশি সচেতন ছিলাম।
প্রশ্ন : ভারতের বিপক্ষে অভিষেক, কোনো চাপ কাজ করেছে?
মোহাম্মদ নাঈম : আসলে খেলার আগে আমি কখনোই এসব নিয়ে চিন্তা করি না। আমার কাজ হলো খেলা। আমি সে দিকেই নজর দেওয়ার চেষ্টা করি। কোন দল বা কার বিপক্ষে ব্যাট করছি, এসব মাথায় আনতে দেইনি। শুধু প্রতিটি বলের দিকে ফোকাস রাখি, প্রতিপক্ষ নয়।
প্রশ্ন : অভিষেক ক্যাপ পাননি?
মোহাম্মদ নাঈম : আসলে প্রথম ম্যাচ, তাই সবাই খুব ব্যস্ত ছিল। এগুলো কারো মাথায়ই ছিল না। আমারও মনে ছিল না। আমার যে অভিষেক হচ্ছে, সেটাই মনে ছিল না। পরে ম্যাচের পর মুশফিক ভাই, রিয়াদ ভাই বলেছেন, ‘তাড়াহুড়োয় তোকে তো অভিষেক ক্যাপ পরানো হয়নি।’ তবে সমস্যা নেই। ক্যাপ ছাড়া খেলেও তো একটা অর্জন ছিল। বাংলাদেশের একটা রেকর্ড হলো। ভারতের বিপক্ষে প্রথম জয়। অনেক ম্যাচ খেলার পর ভারতকে তাদের ঘরের মাঠে হারাতে পেরেছি। এটা আসলে অনেক আনন্দের ছিল। এটার মাঝে অভিষেক ক্যাপ নিয়ে আলাদা করে কোনো ভাবনা আসেনি।
প্রশ্ন : সেই জয় কতটা রোমাঞ্চকর ছিল?
মোহাম্মদ নাঈম : এটা খুবই ভালোলাগার ছিল যে আমার অভিষেক ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছে, তাও আবার ভারতের বিপক্ষে। ওদের মাঠে জিততে পারায় বেশি আনন্দ লেগেছে।
প্রশ্ন : শেষ দিনের আক্ষেপ?
মোহাম্মদ নাঈম : শেষ টি-টোয়েন্টি জিততে খুব মরিয়া ছিলাম। জিততে পারলে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু হাতছাড়া হওয়ায় খুব খারাপ লাগছে। দ্রুত উইকেট পড়ার পরও আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছি। আমার চিন্তা ছিল, নিজের সেরাটা দিয়ে যতটুকু সম্ভব হয় টেনে নেব। যতটুকু সময় থাকি, সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব।
প্রশ্ন : শেষ করার চিন্তা ছিল না?
মোহাম্মদ নাঈম : মিঠুন ভাইয়ের সঙ্গে যখন ব্যাট করছিলাম, তখন বারবার দুজনে পরিকল্পনা করেছি ছন্দ ঠিক রাখার। দুজনের পরিকল্পনা ছিল, আমরা যদি ইনিংসটা অন্তত শেষের দিকে টেনে নিতে পারি, তাহলে আমাদের জেতার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ থাকবে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আক্ষেপ থেকে গেল। মিঠুন ভাই যখন আউট হন, তখন আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি শেষ করে আসব। একদম শেষ বল পর্যন্ত খেলব। দলকে জেতাব। শেষ পর্যন্ত তা পারলাম না।
প্রশ্ন : এমন ইনিংস থেকে কী শিক্ষা নিলেন?
মোহাম্মদ নাঈম : আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমনটা প্রথম, কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে আমার অনেকবার এমন হয়েছে। অনেক ম্যাচে আমি বড় ইনিংস গড়েও শেষ করে আসতে পারিনি। দিন দিন বিষয়গুলো থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি। ইমার্জিং এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচেও ইনিংস বড় করতে পেরেছি, দলও জিতেছে, কিন্তু আমি শেষ করে আসতে পারিনি। দিন দিন বিষয়গুলো থেকে শিখছি, কীভাবে সামনের দিকে বিষয়গুলো আয়ত্তে আনা যায়। কীভাবে ইনিংস ধরে খেলে শেষ করে আসা যায়। বিগত ম্যাচগুলো থেকে নেওয়া শিক্ষা সামনের ম্যাচগুলোয় কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।
প্রশ্ন : ক্রিকেটে শুরুটা কেমন ছিল?
মোহাম্মদ নাঈম : আসলে কোনো কিছুতে যাত্রা কখনো সহজ হয় না। সবকিছুতেই কষ্ট করে আসতে হয়। আমিও অনেক কষ্ট করে ক্রিকেটে এসেছি। সামনের দিকে টিকে থাকতেও কষ্ট করতে হবে। যতদিন খেলব, ততদিনই নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই করতে হবে, কষ্ট করতে হবে। আমি এটাকে উপভোগ করি। আমার ক্রিকেটে আসার শুরুতে বাবার তেমন সমর্থন ছিল না। বাবা চাননি ক্রিকেটার হই। তবে মা আর বড় ভাই অনেক সমর্থন দিয়েছেন। যখন সফল হয়েছি, তখন বাবাও সমর্থন দিচ্ছেন। এখন বাবা খুশি।
প্রশ্ন : এত কিছু থাকতে ক্রিকেট কেন?
ক্রিকেটের শুরুটা হয় অনূর্ধ্ব-১৮ দল দিয়ে। সেখান থেকেই ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নিয়েছি। শুরুর দিকে খেলতে ভালো লাগত, দেখতে ভালো লাগত। একপর্যায়ে ভাবলাম, ক্রিকেটার হবো। আগে ক্রিকেট তেমন বুঝতাম না। অনেক আগে থেকে বাংলাদেশ দলের খেলা দেখা হতো, কিন্তু তেমন বুঝতাম না। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। তবে সেভাবে প্রিয় খেলোয়াড় কেউ ছিলেন না। বড় হতে হতে বোঝার চেষ্টা করেছি, আমি কার মতো খেলি, বা আমার খেলা কার মতো কিংবা আমি কার মতো হতে চাই। আমার প্রিয় খেলোয়াড় কুমার সাঙ্গাকারা। তাঁকে অনেক আগে থেকে অনুসরণ করি।
প্রশ্ন : টেস্ট খেলার স্বপ্ন?
মোহাম্মদ নাঈম : আমি টেস্ট খেলতে চাই। কিন্তু এখন টেস্ট খেলার জন্য এখন আমার উপযুক্ত সময় নয়। আমার আরো সময় লাগবে। টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করতে হলে আরো শিখতে হবে, আরো জানতে হবে, ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করতে হবে। এসব কিছুর পর, নিজেকে তৈরি করে আমি চাই আমার টেস্ট অভিষেক হোক।
প্রশ্ন : প্রথম ম্যাচ নিয়ে পরিবারের উত্তেজনা?
মোহাম্মদ নাঈম : অভিষেক নিয়ে পরিবারের সবাই অনেক এক্সাইটেড ছিল। যদিও ২৮ বলে ২৬ করেছিলাম, কিন্তু এটা নিয়ে সবাই খুব চিন্তা করেছিল। পরে সবাইকে বোঝালাম, এটা কোনো বিষয় নয়। আমরা জিততে পেরেছি, এটাই অনেক বড়। বল কোনো বিষয় নয়। তবুও মা চিন্তা করেছিলেন, (রানের চেয়ে) এত বল খেললাম, পরের ম্যাচ আমাকে খেলাবে কি না।
প্রশ্ন : অবসরে সময়ে কী করেন?
মোহাম্মদ নাঈম : অবসর সময় পরিবারের সঙ্গে কাটাই। এ ছাড়া অন্য কিছু করি না আমি। আড্ডা দিতেও পছন্দ করি না। যে সময়টুকু পাই, পরিবারের সঙ্গেই থাকি।
প্রশ্ন : দেশে ফিরে ইমার্জিং এশিয়া কাপ নিয়ে ব্যস্ততা…
মোহাম্মদ নাঈম : ইমার্জিং কাপে আমাদের শুরুটা খুব ভালো হয়েছে। আমাদের দলটা খুব ভালো। এখন পর্যন্ত খুব ভালো হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব ফোকাস দিচ্ছি। যা যা ভুল করছি, তা সামনের ম্যাচগুলো দিয়ে শোধরানোর চেষ্টা করি। আর আমি বিশ্বাস করি, আমাদের যে টিম, তাতে আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিত। আর আমরা সেটাই হবো।
প্রশ্ন : ভক্তদের উদ্দেশে কিছু?
মোহাম্মদ নাঈম : দর্শকদের বলব, আপনারা ক্রিকেটারদের কখনো ভুল বুঝবেন না। খারাপ বা ভালো সময় আসবেই। এই যে এখন টেস্টে (পারফরম্যান্স) খারাপ হচ্ছে, তাই বলে আমাদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য করবেন না। আমার সবসময় চেষ্টা করি সাফল্য আনার। কখনো হয়, কখনো হয় না। আমরা চাই ভালো-খারাপ দুই সময়েই আপনারা আমাদের পাশে থাকবেন। কারণ আপনাদের সমর্থনই আমাদের ভালো খেলার প্রেরণা জোগায়।