ঘাসফড়িংসদৃশ পোকা ও পঙ্গপাল বাস্তবতা
পঙ্গপাল কী
পঙ্গপাল ও ঘাসফড়িংয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্যগত শ্রেণিভাগ নেই। বিশেষ অবস্থায় তাদের প্রজাতিরা একত্র হওয়ার যে প্রবণতা দেখায়, সেটাই মূল পার্থক্য। সাধারণত পোকার ঘনত্ব যখন কম থাকে তখন পঙ্গপাল ও ঘাসফড়িং বা গ্রাসহপার একই ধরনের ইকোসিস্টেমে থাকে। যখনই উপযুক্ত পরিবেশ পায়, তখন প্রজননের মাধ্যমে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ও ফসলের ক্ষতি করে থাকে, যা সবার কাছে পঙ্গপাল নামে পরিচিত। সাধারণত ছয় হাজার ৮০০ প্রজাতির আক্রিডিড ঘাসফড়িং বা গ্রাসহপার আছে, তার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৯টি প্রজাতিকে লোকাস্ট বা পঙ্গপাল হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
সম্প্রতি টেকনাফে যে পোকাটি দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে কী?
এই প্রজাতিটি নজরে আসার সঙ্গে আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার সহযোগিতায় কিছু পোকার চিত্র সংগ্রহ করি। পরে তা নিজেরা বিশ্লেষণ করি এবং আন্তর্জাতিকভাবে যারা এ ধরনের পোকা নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। এ ছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তাদের যে ইউনিট, যাঁরা পঙ্গপাল নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করেন, তাঁদের কাছেও কিছু ছবি প্রেরণ করেন। পরে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে এটাকে কফির এক ধরনের ঘাসফড়িং বা গ্রাসহপার (spotted coffee grasshopper, Aularches miliaris) হিসেবে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়। যে চিত্রগুলো আমরা পত্রিকায় দেখছি, তা অপিরণত বা নিম্ফালস্টেজ। সচরাচর আমরা যে পঙ্গপাল বলে থাকি, যা আফ্রিকা, আরব পেনিনসুলা, ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত এলাকায় পাওয়া যায়, এটা সেই ধরনের না।
প্রজাতির বিবরণ
এই প্রজাতির অনেকগুলো উপপ্রজাতি বা সাব-স্পিসিস দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যমান, যা স্থানীয় আবহাওয়ার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই পোকাটি বাংলাদেশে নতুন নয়। এটি ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, মালয় পেনিনসুলা, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, জাভা, পাকিস্তানের কিছু অংশ, তিব্বত, নেপাল ও চীনে বিদ্যমান।
এই পোকা বিস্তৃত আবহাওয়া বা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে এবং এদের এভারগ্রিন ফরেস্ট বা ক্রান্তীয় চিরসবুজ বন, জলাভূমি, পাহাড়ি বন এবং উঁচু বনে পাওয়া যায় বেশি। এটা সাধারণত সর্বভুক, তবে একটি ফসলের মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা নয়। রাসায়নিক কীটনাশক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ডিম নষ্ট করে এদের দমন করা সম্ভব।
একটি পূর্ণাঙ্গ পোকা একটি ডিমের পড বা আবরণে একসঙ্গে ৮০টা ডিম মাটিতে পাড়তে পারে। সাধারণত ডিমগুলো সারি করে একটার উপরে আরেকটা সজ্জিত থাকে। একেকটা ডিম পড পাঁচ থেকে সাত সেন্টিমিটার সাইজের হয়ে থাকে।
অপরিণত বা নিম্ফাল স্টেজের পোকা এবং পূর্ণাঙ্গ পোকা গুচ্ছাকারে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। একেকটা অপরিণত পোকা বা নিম্ফাল স্টেজের গুচ্ছে তিন লাখ পর্যন্ত পোকা একসঙ্গে থাকতে পারে, যা পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ পোকা হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় উড়ে যেতে পারে। এক মিটার জায়গায় দুই হাজার অপরিণত বা নিম্ফাল স্টেজের পোকা একসঙ্গে থাকতে পারে।
পূর্ণাঙ্গ পোকা সাধারণত বড় আকৃতির ও উজ্জল রঙের হয়ে থাকে। একটি পুরুষ পোকা ৩৭-৫৫ মি.মি. এবং স্ত্রী পোকা ৪৭-৬৯ মি.মি. লম্বা হয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ পোকার মাথা কালচে, বক্ষ হলুদাভ, সামনের বা উপরের পাখা সবুজ ও উপরে হলুদ দাগ থাকে। এ ছাড়া এর উদরে কালো ও লাল ডোরাকাটা দাগ থাকে। এর উজ্জ্বল রং অন্যান্য পোকা থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য কাজে লাগায়।
কোন কোন ফসলের ক্ষতি করে থাকে?
এরা সর্বভুক, বিশেষ করে অপরিণত বা নিম্ফাল স্টেজের পোকা, যা যেকোনো চাষকৃত বা বন্য গাছকে আক্রমণ করে থাকে। এটি কফি, কলা, নারকেল, সেগুন কাঠ, আম, এলাচ, কাসাভা, কাস্টর, দুরিয়ান, পেয়ারা, ভুট্টা, মালভেরি, ধান, কোকোয়া, আঁখ, মরিচ, তুলা, পাত, রাবার, কাঁঠাল, অড়হর, তিল, সরগাম ও পাইন গাছের একটি গৌণ পোকা।
হুমকি প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি
International Union for Conservation of Nature and Natural Resources (IUCN) এই পোকাকে Lower Risk Near-Threatened taxon for south India বা নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাছাকাছি-হুমকি সম্পন্ন শ্রেণির পোকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া এই পোকাকে সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
ব্যবস্থাপনা
নিবিড় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রথমেই এই পোকা শনাক্ত করে তা দমন করা যায়, বিশেষ করে যখন অপরিণত বা নিম্ফাল স্টেজের পোকা গুচ্ছাকারে থাকে। সাবান পানি দিয়ে অপরিণত বা নিম্ফাল স্টেজের পোকার আক্রমণ থেকে বিরত রাখা যায়। যেহেতু ডিম মাটিতে থাকে একসঙ্গে, তাই ডিমের পড বা আবরণকে ভূমিকর্ষণ বা আবাদের মাধ্যমে যান্ত্রিক উপায়ে দমন করা যায়। সংখ্যা কম হলে পূর্ণাঙ্গ পোকা সংগ্রহ করে তা মেরে ফেলতে হবে। সবশেষে এই কীটপতঙ্গের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে কীটনাশক স্প্রে ও ডাস্ট ব্যবহার অন্যতম।
এখানে উল্লেখ্য, টেকনাফে যে পোকা দেখা গেছে, তা দমনের জন্য সাইপারমেথ্রিন ও ক্লোরোপাইরিফসের মিশ্রণ ব্যবহার করে অনেকটাই দমন করা হয়েছে। তবে সঠিক নজরদারির মাধ্যমে এই পোকাকে দমনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এই পোকার প্রজননক্ষেত্রগুলো দ্রুত শনাক্ত করে তা ধ্বংস করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এ বিষয়ে বিশেষ নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। আতঙ্কিত না হয়ে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ ধরনের অনিষ্টকারী পোকামাকড় থেকে আমাদের কৃষিকে রক্ষায় কাজ করতে হবে।
লেখক : প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, ল্যাবরেটরি অব অ্যাপ্লাইড এন্টোমলজি অ্যান্ড একারোলজি, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়