ঐতিহ্য
মুক্তাগাছার মণ্ডা না খেলে আফসোস!
ঐতিহ্যবাহী ও পুরোনো জেলা ময়মনসিংহ। সেটি এখন দেশের অষ্টম বিভাগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ময়মনসিংহবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে ২০১৫ সালে সেটিকে বিভাগের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একসময়ের বৃহত্তর ময়মনসিংহখ্যাত চারটি জেলা যথা- ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর ও নেত্রকোনাকে নিয়ে সংখ্যায় ছোট হলেও আয়তনে বেশ বড় এ বিভাগটি। ময়মনসিংহ জেলার উপজেলার সংখ্যা ১২টি। তার মধ্যে পুরোনো একটি উপজেলা হলো মুক্তাগাছা।
ইতিহাস থেকে জানা যায় ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারি প্রথার সময় গুরুত্বের কারণেই মুক্তাগাছা ময়মনসিংহ জেলার থানা কিংবা উপজেলা হওয়া সত্ত্বেও তা ময়মনসিংহ সদরের অনেক আগে থেকেই পৌরসভা। আর সেটি ময়মনসিংহ থেকে অন্য পরগনায় হওয়ায় তার রাজা বা জমিদারও আলাদা ছিল। সেই তখন থেকে ময়মনসিংহ শহরেও যেমন রাজবাড়ি ছিল, ঠিক তেমনি মুক্তাগাছাতেও রাজবাড়ি ছিল। যেগুলোর কালের রাজসাক্ষী হয়ে পুরোনো দালানগুলো শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনো। বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন জিনিসের কিছু ঐতিহ্য থাকে। ঠিক সেরকম মুক্তাগাছাও সেই আদি জমিদারবাড়ির জন্য যেমন বিখ্যাত, আবার সেখানকার একটি বিশেষ মিষ্টি ‘মণ্ডা’ হিসেবে পরিচিত। এই মণ্ডা তার স্বীয় স্বাদ, সুঘ্রাণ ও গুণের কারণে বৃহত্তর ময়মনসিংহে তো বটেই, তার সুনামের বিস্তৃতি এখন সারা দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বময় বললেও বেশি বলা হবে না। কেন এটি এত জনপ্রিয়? কেনই বা এর এত নাম-ডাক? কী আছে এতে? স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নগুলো জাগতে পারে সবার মনে।
এটি কয়েকটি খুবই সাধারণ উপাদানে তৈরি করা হয়। সেখানে মূল উপাদান হিসেবে ঘন দুধের ছানা এবং গুড় বা চিনি দিয়ে তা প্রস্তুত করা হয়। আর বাকিটা হলো কারিগরের হাতের কৌশল ও অভিজ্ঞতা। ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা গেছে, সেই ১৮২৪ সাল থেকেই এ ঐতিহ্যবাহী মণ্ডা নামক মিষ্টিটি সেখানে তৈরি হয়ে আসছে। রামগোপাল পাল নামের এক কারিগর প্রথম এ মণ্ডা তৈরি করেছিলেন। সেই রামগোপাল পালকে সংক্ষেপে গোপাল পাল বলা হয়। জনশ্রুতিতে শোনা যায়, সেই তখন থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের এ মণ্ডা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। গোপাল পাল মুক্তাগাছার বিখ্যাত জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর কাছে অভ্যাগত অতিথি ও মেহমানদের আপ্যায়ন করার জন্য প্রথমে এ মণ্ডা প্রস্তুত করেছিলেন। পরে সেই মণ্ডা খেয়ে মেহমানরা খুশি হলে জমিদারও এতে সন্তুষ্ট হন। তখন থেকেই গোপাল পালকে তা তৈরি অব্যাহত রাখার জন্য আর্থিকভাবেও সহযোগিতা দিয়েছিলেন মহারাজা।
এখন সেই গোপাল পালের পঞ্চম বংশধর হিসেবে রামেন্দ্রনাথ পাল এবং তার ভাইয়েরা এ ব্যবসা অত্যন্ত সততা, বিশ্বস্ত ও সুনামের সঙ্গে চালু রেখেছেন। কাজেই সময়ের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এ মণ্ডার ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের। এতদিন পরেও এ মণ্ডার গুণগতমান ঠিক রাখা সত্যিই একটি আশ্চর্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটি হওয়ার কারণ সম্ভবত শুধুমাত্র একটি জায়গায় বংশপরম্পরায় মানসম্পন্নভাবে এ মণ্ডা তৈরি করা। এ মণ্ডা বাংলাদেশের শুধুমাত্র মুক্তাগাছাতেই হয়। সেখানে তাদের দোকানের নোটিশ বোর্ডেই লেখা রয়েছে যে, সারা দেশে তাদের আর কোনো শাখা বা শোরুম নেই। এই মণ্ডার প্যাটেন্ট বা রেসিপি অত্যন্ত গোপনীয় এবং তাই এটা আর কাউকেই দেওয়া হয় না। এক হাতে এবং একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে তৈরি করা হয় বিধায় প্রতিটি মণ্ডাই আকার-আকৃতি ও ওজনে সমান হয়ে থাকে। সে জন্য দেখা গেছে প্রতি কেজিতে ২২টি মণ্ডা ধরে। আর প্রতি পিস যত টাকা মূল্য ধরা হয়, ২২টি হিসাবে তার কেজির মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। দামও নাগালের ভেতরে, যা কোনো রকম দামাদামি ছাড়াই একদামে বিক্রি করা হয়। সেখানে গেলে মণ্ডা তাদের দোকানে বসে খাওয়া যায় আবার যত খুশি কিনে নিয়েও আসা যায়।
মুক্তাগাছার এ মণ্ডা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সব জায়গায় যে কোনো আচার অনুষ্ঠানের জন্য খুবই কদর ও গুরুত্বপূর্ণ। এসব এলাকায় বিয়ে, জন্মদিন, পূজা-পার্বণ ইত্যাদিতে অতিথি আপ্যায়নে সবার পছন্দের এ মণ্ডা ছাড়া যেন চলেই না। দেশি-বিদেশি যার যার অফিসের বড় কর্তাকে খুশিতে চমকে দিতে মণ্ডার জুড়ি নেই। দেশ-বিদেশের কেউ ময়মনসিংহ অঞ্চলে ভ্রমণে এলে মুক্তাগাছার এ মণ্ডার তুলনা নেই। ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে পশ্চিম দিকে ১৬ কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যাবে দেশের সেই একমাত্র মণ্ডার দোকানটি। এ এলাকায় ভ্রমণ করতে আসা সবার পছন্দের আইটেম হলো মণ্ডা, কাজেই মুক্তাগাছা নামটির সঙ্গে মণ্ডা নামটি যেন একটি ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় সবার খেয়াল রাখতে হবে যে, মুক্তাগাছার মণ্ডা বলে দেশের অন্য কোথায় বিক্রি করলে সেটা অবশ্যই মুক্তাগাছার মণ্ডা নয়। কাজেই মুক্তাগাছার মণ্ডা যিনি এখনো খাননি, তাঁরা যে কোনো উপায়েই হোক একবার অন্তত খেয়ে নেবেন। কারণ এটি সত্যিই অসাধারণ। না খেলে সারা জীবনের জন্য এটি একটি বড় আফসোসের বিষয় হয়ে থাকবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়