শ্রম অভিবাসন : দরকার পরিকল্পিত সরকারি উদ্যোগ
বাংলাদেশের বাড়তি জনসংখ্যার হিসাবে শ্রম অভিবাসন দেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। ব্যাপক এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের দায়িত্বশীলদের তৎপরতার ঘাটতি শুরু থেকেই। দেশের বৃহৎ ও সম্ভাবনাময় এ খাতটির দিকে সরকারের মনোযোগ দেওয়া জরুরি। এর যথাযথ ব্যবহারে দেশের সমৃদ্ধি সম্ভব। এ লক্ষ্য সামনে রেখে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বিপুলসংখ্যক জনশক্তি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কেবল জনশক্তি পাঠানোতেই দায়িত্ব শেষ নয়, প্রয়োজন সার্বক্ষণিক মনিটর। শ্রমশক্তির মর্যাদা, স্বার্থরক্ষা, নিরাপত্তা, কমিউনিটির সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের জন্য তদারকি প্রয়োজন। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রমশক্তি রপ্তানির বিষয়টিও জটিলতা বাড়ায়। একটা ব্যাপার সত্য, দেশের কর্মক্ষম মানুষের আবেগ আছে। তাদের আবেগকে কাজে লাগানো সরকারি দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাপক উদ্যোগ দরকার। প্রয়োজন অঞ্চলভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া। এগুলো করা হচ্ছে না, এটি আরেকটি দুঃখজনক বাস্তবতা। সে সময়েই আবেগী কর্মক্ষম যুবকগুলো দালালদের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই তাঁরা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। সাগর বা আকাশপথে বিদেশ যাওয়ার সময় দুর্যোগের মুখোমুখি হন। কখনো সাগরে দিনের পর দিন ভেসে থাকতে হয়। পানি ও খাবারের অভাবে দেহাবসান ঘটে। কখনো বিদেশের কারাগারে আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগবিহীন দিন কাটাতে হয়। ভাগ্য একটু সুপ্রসন্ন হলে লুকিয়ে হয়তো দু-একটা কাজ জোগাড় করতে সক্ষমও হন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ধারা দুর্বল। কষ্টসহিষ্ণু মানবিকতারও দেখা মেলে না সে সময়। অথচ প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত তথ্য, সঠিক প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে বিদেশ গেলে সফলতার সম্ভাবনা বেশি। দরকার ভাষাগত দক্ষতাও। যদিও প্রশিক্ষণের মধ্যেই তা অন্তর্ভুক্ত।
সম্প্রতি মানব পাচারের বিষয়টি ব্যাপক আকারে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিত জানা জরুরি। দেশে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। অশিক্ষিত শ্রমশক্তি রয়েছে আরো প্রায় কয়েক লাখ। বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর মেধা আছে। শ্রম দেওয়ার মতো শক্তি আছে। আছে পরিশ্রমের মানসিকতা। জীবনপ্রবাহের নিদারুণ বাস্তবতার জন্য হলেও তাদের চাকরি দরকার। দরকার উপার্জনক্ষম কর্মক্ষেত্র। তারা কর্মহীনতার কষ্টকর বাস্তবতা অস্বীকার করবে কীভাবে? যখন তাদের কর্মসংস্থান বা শ্রম অভিবাসনের ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ অপ্রতুল থাকে কিংবা সরকারের দায়িত্বশীলদের আগ্রহ ও সদিচ্ছার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়, তখনই তারা বিদেশের শ্রমবাজারের দিকে ধাবিত হয়। বৈধ ও সরকার-স্বীকৃত পদ্ধতির অব্যবস্থাপনায় তারা অবৈধ পথটিই বেছে নেয়। মানব পাচার ইস্যুটি সামনে আসে। ইউএনএইচসিআরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশের শ্রমক্ষম দেড় লাখের বেশি জনশক্তি অবৈধ উপায়ে দেশের বাইরের শ্রমবাজারের দিকে ধাবিত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইতালি, থাইল্যান্ড, ইউরোপ প্রভৃতি দেশ তাদের লক্ষ্য। সম্প্রতি থাইল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়ায় গমনকারীদের দুরবস্থার চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ রকম দুরবস্থার আরো অনেক চিত্র গণমাধ্যমের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে সরকারি সুষ্ঠু উদ্যোগ জরুরি।
দেশ ও জাতির স্বার্থেই সরকারের উচিত এ খাতকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে গুরুত্ব দিয়ে লোকবল নিয়োগ করা, যারা সুষ্ঠুভাবে শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনা করবে। শ্রম অভিবাসনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই দেশের প্রশিক্ষিত জনশক্তি দ্বারা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার সম্ভব। বিশ্বজনীন অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে বিষয়টি জরুরিও বটে। সময়োপযোগী সরকারি উদ্যোগ ও কার্যকর শ্রমব্যবস্থাপনা প্রত্যাশিত। বেশি পরিমাণ শ্রমশক্তির আন্তর্জাতিক বাজার ও গ্লোবাল কর্মক্ষেত্র তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।