ডিয়ার ছাত্র ইউনিয়ন—এনজয় ইট
ফেসবুক আর ব্লগ জমে উঠেছে। চলছে ছবিযুদ্ধ। দুই পক্ষই ছবি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করছেন, দোষ অপর পক্ষের। অন্য সব ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। ‘দোষ ইসমত জাহানের। সে কেন টব ছুড়ল?’ অন্য পক্ষের বক্তব্য, ‘তাই বলে একজন নারীর গায়ে হাত তুলতে হবে?’ যথারীতি, কোনো পক্ষই হারতে রাজি হচ্ছেন না। এবং কথাবার্তা ধীরে ধীরে নিচু থেকে নিচুতর স্তরে যাচ্ছে। অচিরেই হয়তো ‘চ’ বর্গীয় গালিগালাজ শুরু হবে। ঘটনার কেন্দ্রে যেহেতু একজন নারী, তাই হয়তো অচিরেই তাঁর চরিত্র নিয়ে টানাটানি হবে। আমার মনে এমন ধারণা তৈরির কারণ, বেশ কিছুদিন আগে সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের অগ্রগতি নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই লাইনে যাত্রা শুরু করেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি পিছিয়ে যান। এবার কী হবে, তা দেখার বিষয়। তবে একটি ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তা হচ্ছে বর্তমান ঘটনাবলির পরে আমাদের প্রাপ্তি। অচিরেই আমাদের এই প্রাপ্তি সবার সামনে আসবে। আর সেটি হচ্ছে ‘স্মৃতিভ্রংশ’। খুব বেশি সময় লাগবে না, নিশ্চিত থাকুন, আমরা ভুলে যাব, আদৌতে এমন কিছু একটা হয়েছিল।
এ দেশের রাজনীতি বা পুলিশের যে সংস্কৃতি, তাতে আওয়ামী কিংবা পুলিশ বাহিনী সর্বসমক্ষে যে তাদের দোষ স্বীকার করবে না, তা প্রায়(?) অবধারিত। অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যে চেষ্টা সাধারণত করা হয় তা হচ্ছে, ‘আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্য করতে হয়েছে’ জাতীয় কিছু বক্তব্য। তেমনি কিছু বক্তব্য এসেছে, হয়তো আরো কিছু আসবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও কমবেশি একই জাতীয় বক্তব্য আসবে। খুব দ্রুত আরেকটি রোমহর্ষক ঘটনা ঘটলে সেটার হয়তো আর দরকার পড়বে না। শিরোনাম থেকে সরে গেলে সেই ঘটনা নিয়ে পাঠক-দর্শক কেউই আর খুব বেশি আগ্রহী থাকে না।
আগেই বলেছি, এ ঘটনা যে আমরা ভুলে যাব, তা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তা কবে নাগাদ হবে, তা নির্ভর করছে আওয়ামী থিঙ্কট্যাঙ্কের পরবর্তী সিদ্ধান্তের ওপর। নতুন কোনো ঘটনার জন্ম দেওয়া হবে কি না, তা নির্ভর করছে আপাতত আওয়ামীরা কী চাইছে। ঘটনাটা শিরোনামে থাকলে তারা সমালোচিত হচ্ছে বা হতে থাকবে, তা ঠিক তবে সেটার একটা উপকারিতাও কিন্তু আছে। ‘তারানকো’, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন’, ‘মার্কিন শুনানি’ সবকিছু শিরোনাম থেকে এ মুহূর্তে আউট। বিএনপি ও তার নেতাকর্মীদের গুম হওয়া আর নেই শিরোনামে। সালাহ উদ্দিনের অন্তর্ধান রহস্যও আর এখন কোনো ‘আকর্ষণীয়’ খবর নয়। মাঝেমধ্যে খবর হিসেবে আসছে, ‘বেহাল বিএনপি’ কিংবা ‘তারেক রহমান অসন্তুষ্ট’—এ জাতীয় খবর।
এই নারীকে লাথি মারা কিংবা লাকীর মাথা ফাটানো নিয়ে আমি এ মুহূর্তে বেশি ভাবছি না। ভাবছি আওয়ামী থিঙ্কট্যাঙ্ক এখন কী ভাবছে। বিরোধী ছাত্রসংগঠন বলে তো তেমন কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। ছাত্রদল নেই, শিবিরও চুপচাপ।
যা কিছু একটা হচ্ছে, তা মাঝেমধ্যে করছে এই ছাত্র ইউনিয়ন। এদেরকে আর বাড়তে দেবে না, তাদের সীমানা নির্ধারণ করে দেবে, এটাই এখন দেখার বিষয়। জুন মাসে মোদিবাবু আসছেন, ছিটমহল বিনিময় নিয়ে চুক্তি হবে, এ খবরকে অচিরেই শিরোনাম করা খুব জরুরি না। বাঙালি যেহেতু এক খবর বেশিদিন খায় না, তাই সম্ভবত সেই খবরগুলোকে শিরোনাম করা হবে জুনের প্রথম দিকে। আপাতত তাঁদের প্রথম চেষ্টা হবে সিটি করপোরেশনকে এবং সেই নির্বাচনে হওয়া কারচুপি এবং সেই কারচুপির ব্যাপারে বিশ্ববাসীর মতামতের খবরগুলো শিরোনাম থেকে সরানো। যদি ভুল না করি তবে আমার ধারণা, সমালোচিত হলেও এ মুহূর্তে তারা চাইছে এই নারী নির্যাতনের ঘটনাটা শিরোনামে থাকুক।
ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা সিপিবি-বাসদের যেহেতু নিজেদের তেমন শক্ত মেরুদণ্ড নেই এবং সম্ভবত খুব সহজেই, ম্যানেজ করা যাবে। ম্যানেজ মানে এই না যে পয়সা দিয়ে, কখনো ‘চেতনা’ দিয়েও হয়। বলা হয়, আমাদের অন্যায়কে সমর্থন করো, নইলে জামায়াত এসে যাবে। তারাও রাজি হয় যায়। গুম কিংবা বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে কোনো কথা বলতে বারণ করে, তারাও রাজি হয়ে যায়। আওয়ামীদের এখন শিরোনাম চাই, আবার বিরোধী দল বলেও তেমন কিছু নেই, তাই বামদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে। পরে একসময় একটা ডিল করে নিলেই হবে।
বড় দলের ছত্রছায়াপ্রত্যাশী এসব বাম দলের সঙ্গে যেকোনো মুহূর্তেই একটা ডিল হবে, তা নিয়ে আমার তেমন কোনো সন্দেহ নেই। ডিলের অংশ হিসেবে হয়তো আসবে একটা লোকদেখানো ‘সাময়িক বরখাস্ত’ কিংবা ‘পুলিশকে আরো সহনশীল হতে হবে’ জাতীয় বক্তব্য। (এরই মধ্যে একজন নায়েককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, হামলায় সরাসরি আরো যে কর্তাদের দেখা গেছে, তাঁরা আছেন বহাল তবিয়তে)। কিংবা অবস্থা বুঝে ‘এমন আচরণ বরদাশত করা হবে না’ জাতীয় কঠিন কিছু। অচিরেই মানববন্ধন কিংবা বিক্ষোভ সমাবেশ হবে এবং সেগুলো শান্তিপূর্ণও হবে। টক শো কিংবা টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়ে কয়েকজন হয়তো একটু সেলিব্রেটি হবেন। এবং সম্ভবত সেগুলোও ডিলের অংশ।
যথারীতি পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে। আবার তাঁদের মাঝে ‘চেতনা’ জাগবে এবং আবার তাঁরা জামায়াত আটকানোর যুক্তিতে আওয়ামী অন্যায়ের পক্ষে যুক্তি হাজির করবেন।
আজ যারা কিংবা বলা যায়, ছাত্র ইউনিয়ন বা বাম দলের যে লোকজন নানা কথাবার্তা বলছে, তাদের দেখে বেশ বিনোদিত হচ্ছি। এদের অনেককেই দেখেছি, ৫ জানুয়ারির পক্ষে কথা বলতে। যুক্তি ছিল, ‘কাজটা অন্যায় হলেও, উপায় ছিল না।’ এমনটা না করলে জামায়াত ক্ষমতায় চলে আসত। অর্থাৎ আওয়ামীরা অন্যায় করলেও তা মেনে নিতে হবে, কারণ উদ্দেশ্য মহৎ। গুম, বন্দুকযুদ্ধ কিংবা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার নিয়েও তাঁদের আচরণ ছিল একই জাতীয়। ‘এরা বিজাতীয় প্রাণী। এদের সাথে এমনই করা উচিত।’
বামধারার বুদ্ধিজীবী আকাশ সাহেবও তাঁর এক লেখায় জানালেন, ‘তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক, প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির এ ক্ষেত্রে যা করণীয় সেটা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসী শক্তিকে যদি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগ করেও দুর্বল ও নিঃশেষিত করতে পারে, তাতে বাগড়া না দেওয়া।’ তবে তিনি যে ব্যাপারটি বুঝতে পারেননি তা হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট আচরণ একবার শুরু হলে তা বাড়তে থাকে। প্রয়োজন ছিল বলে সেদিন হয়তো বামদের ছেড়ে কথা বলা হয়েছিল, তবে সব সময় কিন্তু পরিস্থিতি তেমন থাকে না।
তাঁরা সেদিন যেটা বুঝতে পারেননি তা হচ্ছে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কখনোই বিরোধিতা সহ্য করে না। এবং বিরোধিতা দমন করার জন্য সবচেয়ে যখন যেমন প্রয়োজন, তেমন যুক্তি ব্যবহার করে। কখনো ‘চেতনা’ কখনো ‘আইনশৃঙ্খলা’।
যতদিন বামরা তাদের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়েছে, আওয়ামীদের অন্যায়ে সায় দিয়েছে, ততদিন গায়ে আঁচড় লাগেনি। তবে অন্যথা করলে যে বামদের ছেড়ে কথা বলা হবে না, তা বুঝিয়ে দেওয়া হলো। বামদের উদ্দেশে এবার আওয়ামীরা হয়তো বলবেন, ‘আওয়ামীদের কাজ আপাতদৃষ্টিতে ভুল মনে হলেও আসলে তা ভুল নয়। এবারও মেনে নিন। এবারও আমাদের উদ্দেশ্য মহৎ। একটু ফ্যাসিস্ট আচরণ করেছি, তবে তা করা যুক্তিসংগত ছিল। তাই বাগড়া দিয়েন না।
যায়নুদ্দিন সানী : লেখক ও সহকারী অধ্যাপক, রংপুর মেডিকেল কলেজ।