আন্তর্জাতিক ওজোন দিবসে নিরাপদ পৃথিবীর প্রত্যাশা
দিবসটির ইতিহাস ও তাৎপর্য বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, ১৮৪০ সালে ‘ওজোন’ নামের রাসায়নিক গ্যাসটি আবিষ্কারের পর থেকে এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা গবেষণা চলতে থাকে। সব গবেষণাতেই একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে এসেছে যে ওজোন একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস। এটি বায়ুমণ্ডলের মধ্যে থাকা একটি অদৃশ্য বায়ুর স্তর।
কাজেই এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরকে রক্ষা করার জন্য ১৯৮৫ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় একটি কনভেনশনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর বিশ্বের মানুষ যখন আস্তে আস্তে পরিবেশ সচেতন হতে লাগল, তখন সে বিষয়টি সামনে রেখে ১৯৮৭ সালে আবার কানাডার মন্ট্রিলে ‘মন্ট্রিল প্রটোকল’ স্বাক্ষরিত হয়। সেই প্রটোকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের একটি অধিবেশনে ১৯৯৪ সালে ১৬ সেপ্টেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সে অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি (ইউএনইপি) কর্তৃক প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সূর্য থেকে পৃথিবীর দিকে আসা ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে আসতে বাধা সৃষ্টি করে থাকে ওজোনস্তর। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠে বাস করা জীবের জন্য খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট কিছু রাসায়নিক উপাদান এ ওজোনস্তরকে পাতলা করে ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সেই গ্যাসগুলো একত্রে জড়িত হয়ে ওজোনের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ওজোনস্তরকে প্রথমে পাতলা করে দিচ্ছে এবং আস্তে আস্তে সেই পাতলা স্তর আরো পাতলা করে ফুটো হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষতির জন্য দায়ী রাসায়নিক পদার্থগুলোকে এককথায় ওজোন ক্ষয়ের উপাদান বা ওজোন ডিপ্লেটিং সাবস্ট্যান্স (ওডিএস) বলে। এসব ওডিএসর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস এবং সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন), এইচসিএফসি (হাইড্রো ক্লোরোফ্লোরো কার্বন), হ্যালন, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, মিথেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথাইল ব্রোমাইড, মিথাইল ক্লোরোফর্ম ইত্যাদিই প্রধান।
আগেই বলেছি, ওজোন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক গ্যাস। এটি বায়ুমণ্ডলের চতুর্থ স্তর, যা ‘স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার’ হিসেবে পরিচিত। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ মাইল পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এটি অদৃশ্য হালকা একটি গ্যাসীয় স্তর। এটি সূর্যালোক থেকে বিকিরিত অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে নীলবর্ণ ধারণ করে। সে জন্য মাথার ওপরে পরিষ্কার আকাশে যে নীলাভ রং দেখা যায়, সেটাই ওজোনস্তর। আমরা সহজেই বলে থাকি, আকাশের রং নীল, মানে সেটি আসলে ওজোনস্তরেরই রং।
ওজোন হলো রাসায়নিকভাবে অক্সিজেনের একটি ভারী রূপ কিংবা অক্সিজেনেরই সমরূপী গ্যাসীয় পদার্থ। দুই পরমাণু মৌল অক্সিজেন একত্রে বন্ধন সৃষ্টি করে রাসায়নিকভাবে (ও২) বিরাজ করে। বাতাসে আনুপাতিক হারে এর উপস্থিতি শতকরা প্রায় ২১ ভাগ। সেই দুই পরমাণু অক্সিজেনের সঙ্গে আরো এক পরমাণু অক্সিজেন মৌল যুক্ত হয়ে দিন পরমাণু অক্সিজেন সমন্বয়ে এক অণু ওজোন তৈরি হয়। সেই ওজোনের অণুকে ধ্বংস করার জন্য ওডিএসগুলো থেকে ক্লোরিন, ব্রোমিন ইত্যাদি মৌল বিচ্যুত হয়ে ওজোনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওজোন থেকে একটি অক্সিজেন মৌল ভেঙে ক্লোরিন বা ব্রোমিন অক্সাইড তৈরি করে এবং দ্বি-পারমাণবিক অক্সিজেন বাতাসে মুক্ত হয়ে মিশে যায়। এভাবে এক পরমাণু ক্লোরিন বা ব্রোমিন এক লাখ অণু ওজোনকে ভেঙে দিতে পারে। তাই দিন দিন ওজোনস্তর পাতলা হতে হতে মাঝখানে ফুটো হয়ে গিয়ে সেখান দিয়ে সূর্যের শতভাগ অতিবেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠে চলে আসছে।
ওজোনস্তর ক্ষয়ে গেলে শুধু যে সূর্যের সেই অতিবেগুনি রশ্মিগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠে চলে আসছে তা-ই নয়, সূর্যের আলোক বিকিরণের কারণে তার অধিকাংশ ক্ষতিকর তাপ এসে পড়ছে জীবজগতের উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ওপর। আবার এর ফলে যে শুধু মানুষের ক্ষতি হচ্ছে তা-ই নয়, এ ক্ষতির ভয়াবহতা এসে পড়ছে তাবৎ জীবজগতের ওপর। মানুষের শরীরে বিশেষত সাদা চামড়ার ত্বকের ক্যানসার, চোখে ছানি পড়াসহ অন্ধত্ব, প্রাণিজগতের আরো নানা রকমের রোগব্যাধি, কৃষিতে ফসল হিসেবে ধান ও সয়াবিনের মতো যাবতীয় লতাগুল্ম ও শস্যের মধ্যে খাদ্য প্রস্তুতকারী সালোক-সংশ্লেষণের মাত্রা কমে যায়, সব রকম শস্য চারা ও বীজের প্রাণের উদ্বেলতা ব্যাহত হয়, সামুদ্রিক এককোষী উদ্ভিদ শৈবাল ও এককোষী প্রাণী প্রোটোজোয়াসহ সব খাদ্য শৃঙ্খলের (ফুড চেইন) উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং সর্বোপরি ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে পৃথিবীর ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এ ওজোনস্তরের ক্ষয়রোধ করতে হলে যেসব কারণে এর ক্ষয় হয়, সেগুলো ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
আধুনিক সভ্যতার অনেক কিছু, যেমন—টিভি, ফ্রিজ, এসি, কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি থেকে সব সময়ই বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস ও ওডিএস নিঃসৃত হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার্থে মানুষকে এসব জিনিসের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। তবে যে জিনিস একবার ব্যবহার করে মানুষ আরাম-আয়েশের বেড়াজালে আটকে গেছে, শত হৈচৈ সত্ত্বেও তা ব্যবহার থেকে মানুষকে বিরত রাখা যাবে না। কিন্তু এখন ওজোনস্তরকে রক্ষা করার জন্য হলেও এর বিকল্প বের করতে হবে। অন্যথায় আমাদের জন্য সুন্দর ও বাসযোগ্য এ বসুন্ধরাকে কোনো অবস্থাতেই বাঁচানো যাবে না।
আমরা একটি বিষয় খুব ভালোভাবে জানি যে, নিজের আশপাশের পরিবেশকে সঠিক ও সুন্দরভাবে রাখতে পারলেও বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব কোনো একক দেশের নয়। কোনো একটি দেশ এসব বিষয়ে খুব বেশি মাত্রায় ভূমিকা রাখতে পারে না। তবে উদ্যোগ নিতে পারে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ একটি ছোট ও অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ হলেও এসব উদ্যোগের ক্ষেত্রে কখনো পিছিয়ে থাকার ইতিহাস নেই।
আর সে জন্যই দেখা গেছে, সেই ১৯৮৫ সালের ভিয়েনা কনভেনশন থেকে ১৯৮৭ সালে মন্ট্রিয়ল প্রটোকল—সবকটিতেই বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং এসব চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯৯৪ সাল থেকেই বাংলাদেশও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রতিবছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস’ পালন করে থাকে। এ বছরও (২০১৬) এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
এসব দিবস পালনের জন্য প্রতিবছরই একটি প্রতিপাদ্য থাকে। জাতিসংঘ যেমন ধরিত্রীকে ওজোনস্তর ক্ষয়ের হাত থেকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে একটি নির্দিষ্ট দিনে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এবারে ২০১৬ সালের জন্যও একটি সর্বজনীন প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে। আর তা হলো ‘ওজোন অ্যান্ড ক্লাইমেট : রেস্টোরড বাই আ ওয়ার্ল্ড ইউনাইটেড’; বাংলায় যার ভাবার্থ দাঁড়ায় ‘ওজোন এবং জলবায়ুর ক্ষতিপূরণের জন্য বিশ্বকে একত্র হতে হবে’। এ প্রতিপাদ্য সামনে নিয়েই বাংলাদেশও দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন এবং পরিবেশবাদীরা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর অনেক আগে থেকেই একটি ‘ওজোন সেল’ খুলেছে। সেখান থেকে প্রতিবছর ও সারা বছর ওজোনস্তর রক্ষার্থে গৃহীত সব পদক্ষেপের কার্যক্রম সম্পর্কে ওজোন সদর দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়ে থাকে। কাজেই বিশ্বের যেখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে একটি অন্যতম হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে, ঠিক সে সময়ে আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের জন্য অন্য রকম গুরুত্ব বহন করে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।