বন্ধুত্ব
হাল ছেড়ো না বন্ধু
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের একজন এবং একাধারে বিজ্ঞানী, লেখক, রাজনীতিবিদ ও কৌতুকবিদ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বন্ধু বিষয়ে বলতেন, ‘There are three faithful friends : an old wife, an old dog, and ready money।’ বন্ধুত্বের রকমফের দেখে দেখে যাঁরা নিজের সময়ের বেশির ভাগ অংশ নিঃশেষ করেছেন, তাঁরা জানেন কথাগুলো কতটা সত্য। তবে পুরোনো বন্ধুত্বে শাণ দিতে হাল না ছেড়ে কণ্ঠ সুধায় মাততে বলেছেন কলকাতার বাঙালি বন্ধু শিল্পী কবীর সুমন।
হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে,
দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে..
ছেড়েছ তো অনেক কিছুই, পুরোনো সেই হাসি
সকাল-বিকেল জানিয়ে দেওয়া তোমায় ভালোবাসি,
হাল ছেড়ো না!
অথবা সুমনের গানে গানেই পাল্টে যাওয়া বন্ধুর জন্য বিষণ্ণ আকুতি বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে :
বন্ধু, কী খবর বল
কত দিন দেখা হয়নি
সময় চলে গেছে এবং চলছে
চলতি জীবনের গল্প বলছে
পাল্টে গেলি তুই আমিও পাল্টে
গিয়েছি মাঝ পথে হাতে হাতে
বন্ধু, কী খবর বল।
বন্ধুত্ব এমনই! সে আসে রৌদ্রের ঝলকানি নিয়ে! শীত কুয়াশার ধোঁয়াশায় মিশে গিয়ে বসন্তে বিলীন হয়।
মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব হয়। আবার দ্বিপদ সভ্য প্রাণীর সঙ্গে চতুষ্পদী, বহুপদী অথবা পদবিহীন পশুপাখি, বৃক্ষলতার বন্ধুত্বও বিরল নয়। এই যেমন গেল বছর শোনা গিয়েছিল, সিংহের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বের এক বিরল কাহিনী। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সিংহের মতো এমন হিংস্র একটি জন্তু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রতিদান দিতে গিয়ে নিজের সত্তাকেই যেন সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে ফেলেছে। বন্ধুর আরো কাছাকাছি থাকতে গিয়ে নিজেকে পুরোপুরিভাবে পাল্টে ফেলেছে ওই সিংহটি। হুঙ্কার ও গর্জন করা যার স্বভাব, সেই সিংহ বন্ধুত্বের জন্য যেন এক নিরীহ প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।
এখন থেকে চার বছর আগে জার্মানির বন্যপ্রাণী সংরক্ষক ভ্যালেনটিন গ্রুয়েনার কুড়িয়ে পান এক সিংহী শাবককে। বটসোয়ানা মরুভূমির উত্তপ্ত পরিবেশে মৃত্যুর মুখে পড়েছিল ওই শাবক। গ্রুয়েনার তাকে তুলে নিয়ে যান মডিসা অভয়ারণ্যে। নিজের হাতে সযত্নে সেবা-শুশ্রূষা করে প্রাণ বাঁচান শাবকটির। আর সে থেকেই শুরু হয় তাদের গভীর বন্ধুত্ব। ভ্যালেনটিন শাবকটির নাম দিয়েছেন সিরগা।
সেই সিরগার কাছ থেকেই ভালোবাসা, মমতা বা বন্ধুত্ব বিষয়ে অনেক কিছু শিখছেন ভ্যালেনটিন। তেমনি তিনিও সিরগাকে শিকার করা, অন্য বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করাসহ মানবীয় নানা গুণপনার শিক্ষা দিচ্ছেন ভ্যালেনটিন গ্রুয়েনার। এটাই নিখাদ বন্ধুত্ব!
কিন্তু আমরা বন্ধুত্বের ‘ব’-কেও যেন ঠিক হারিয়ে ফেলছি দিন দিন। এ সময় অস্থির তারুণ্য তার আসল বন্ধুর খোঁজ না পেয়ে ভয়ানকভাবে বিপথগামী হচ্ছে। সে ঠকাচ্ছে নিজের মাকে, দেশকে, সকল মানুষকে এবং সর্বোপরি নিজেকেই। বহু সাধনায় পাওয়া আপন সত্তাকে বিকশিত বা প্রকাশ করার সুযোগ না দিয়ে অমূল্য জীবনের অপচয় করছে তারা। বিনিময়ে নিজের স্বজন, পরিবার ও জাতিকে দিচ্ছে করুণ হাহাকার ও আহাজারি। আর নিজেরা কুড়িয়ে নিচ্ছে অভিশাপ ও ঘৃণার অথৈ সমুদ্র।
এবার তবে সময় এসেছে কাজের ব্যস্ততার বাহানা ছুড়ে ফেলে তরুণ সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার নিখাদ বন্ধুত্ব গড়ার। অভিভাবক হয়ে আপনার উত্তরসূরি খুদে বন্ধুটিকে শেখাতে হবে জীবনকে ভালোবেসে মানুষ হয়ে ওঠো আগে, তার পর হোক এই জীবন যার দান সেই জীবনদেবতা স্রষ্টার আরাধনা। বিদ্যাভ্যাস, খেলাধুলা বা সুকুমারবৃত্তি চর্চা শিকেয় তুলে ঘরের ঘুপচি ঘরে বসে বসে অথবা নিখোঁজ হয়ে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক আঁধারের যাত্রীর সখ্যের অন্তর্জালে ঘুরে ঘুরে আরোপিত গিনিপিগিও ধর্মযুদ্ধের নাম করে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যার ফন্দিফিকিরের চেয়েও বড় কাজ করার আছে মানুষের!
সন্তানকে ধর্মকথার পাশাপাশি সাহিত্য, শিল্পকলা, সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে মহত্তম বোধের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে দিন। তাকে শেখাতেই হবে, আইনস্টাইন, নিউটন, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, শেকসপিয়র, রুমি, কার্ল মার্কস, পিকাসো, ভ্যানগগ, বার্নার্ড শ, লিও তলস্তয়, বার্ট্রান্ড রাসেল, দস্তয়ভস্কি, ইবসেন, মার্লো, প্লেটো, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, সফোক্লিস বা হোমারের চিন্তা ও ভাবনাসূত্রের ম্যাজিক। আর এসব বরেণ্য ও মহান ব্যক্তির চিন্তার উৎকর্ষের চূড়াতেই মিলবে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্বের পোক্ত সোপান হলো আশা আর বিশ্বাস।
শেকসপিয়র যেমনটা বলতেন, ‘কাউকে সারা জীবন কাছে পেতে চাও? তাহলে অন্ধ প্রেম দিয়ে নয়, বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখো। কারণ, প্রেম একদিন হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বন্ধুত্ব কোনোদিন হারায় না।’ পথ হারানোর আগেই যুবকের মনোজগতে আইনস্টাইনের ভাষাটা গুঁজে দিতে হবে, ‘আমাদের রহস্যময়তার পরীক্ষণে প্রাপ্ত সবচেয়ে সৌন্দর্যময় জিনিসগুলো হলো শিল্প, বিজ্ঞান ও বন্ধুত্ব।’ ‘দুটি দেহে একটি আত্মার অবস্থানই হলো বন্ধুত্ব’, মহামতী অ্যারিস্টটলও এমনটা বলেছেন। আমরা তাই নিজেদের নিঃশেষিত করার আগে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশটাকে ডুবিয়ে দেওয়ার আগে মানুষ হয়ে অপর মানুষের আত্মাটা স্পর্শ করার আরাধনাটা যেন করি।
আপনি বন্ধুর কাছ থেকে মমতা চান, সমবেদনা চান, সাহায্য চান, সে জন্যই বন্ধুকে চান—রবিঠাকুরের এই বোধের সঙ্গে কে না হবেন সতীর্থ?
আজ বন্ধু দিবস! কিন্তু বাঙালি রাজনীতিতে অবন্ধুত্বের দাসত্ব শৃঙ্খলজাত গপ্পো ছাড়া আর কী-ই বা শোনানো গেল? আমাদের রাজনীতির অবন্ধুরা যে, কবি জন লিলির উপন্যাস ‘ইউফুয়েস : দি অ্যানাটমি অব উইট’ ভালো করে আত্মস্থ করেছেন। লিলি বলেছেন,
‘All is fair in love and war.’
তবু মানুষের বন্ধুতা বেঁচে থাকুক! হারানো বন্ধুতা ফিরে আসুক! এটাই স্বপ্নচারী সব মানুষের প্রাণদায়িনী আশাবাদ! শেষে আমাদের দেশের বিবদমান অবন্ধুসহ সকলকেই বলতেই পারি,
আপনারা যথেষ্ট পুরোনো হয়েছেন… বেশ পরিণত হয়েছেন... তাই- Make love, not war…!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।