তাসমান সাগরপাড়ে তিন ম্যান অব দ্য ম্যাচ
তিন-তিনটা ক্রিকেট ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচের জন্ম দিয়েছে এই শহর, শহরের নাম ল্যাঙ্কেস্টন। ক্রিকেট মানচিত্রে ল্যাঙ্কেস্টন শহরটাকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। গুগলে সার্চ দিলে পাবেন। গোটা কয়েক পুরোনো মাঠের খোঁজও পাবেন। কিন্তু বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়ার এই ছোট্ট শহরটাকে দিয়েছে পরিচিতির নতুন মাত্রা। এমনিতে তাসমানিয়া অস্ট্রেলিয়ার একটা দ্বীপ। আয়তন আর লোকসংখ্যার দিক থেকে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ছোট প্রদেশ। আর সেই তাসমানিয়ার উত্তরে ছোট শহর ল্যাঙ্কেস্টন। যে শহরের লোকসংখ্যা সব মিলিয়ে লাখখানেক হতে পারে। তবে শহরটাকে বলা হয় নদীর শহর। ‘রিভার্স সিটি’। সাউথ ইসক আর নর্থ ইসক দুটো নদীর সঙ্গমস্থলও এটা। সেই শহরে বিশ্বকাপের ম্যাচ দূরে থাক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়েছে বলে কেউ মনে করতে পারেন না! অথচ ক্রিকেট-ঈশ্বর দুই হাত উজাড় করে দিয়ে এই শহরকে সমৃদ্ধ করেছেন অন্যভাবে। বিশ্বকাপ এলেই ইতিহাসমনস্ক লোকজনের মনে পড়বে এই শহরের নাম। ক্রিকেট ইতিহাস আর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বিশ্বের অনেক বড় বড় শহর-নগর রয়েছে। কিন্তু তারা যা পায়নি, এই পুঁচকে শহরটা তা-ই পেয়েছে! আবার অন্যভাবে বলা যেতে পারে, ক্রিকেটকে অন্যরা যা দিতে পারেনি, এই শহর তা-ই দিয়েছে!
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ৪০ বছরের ইতিহাসে কত বড় বড় তারকার আবির্ভাব ঘটেছে। ক্রিকেটানুরাগীরা জেনেছেন, তাঁদের উঠে আসার গল্প থেকে শুরু করে বিশ্বমঞ্চে দ্যুতি ছড়ানোর কাহিনী। লয়েড-চ্যাপেল-ভিভ-বোথাম-হ্যাডলি-কপিল-মহিন্দর-ইমরান-আকরাম-লারা-ডিসিলভা-জয়সুরিয়া-ক্লুসনার-ক্রোনিয়ে-স্টিভ ওয়াহ-শেন ওয়ার্ন-শচীন-সৌরভ—কত বড় বড় নাম। এদের সঙ্গে বারবার উচ্চারিত হয়েছে তাঁদের উঠে আসা সেই শহরগুলোর নামও। কিন্তু ল্যাঙ্কেস্টন শহরটার নাম কি খুব জোরেশোরে শুনেছেন? মনে হয় না। অথচ এই শহর জন্ম দিয়েছে তিন-তিনটা বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচকে! আর এটা যদি হতো মুম্বাই, লাহোর, করাচি, কলম্বো, দিল্লি, কলকাতা, ঢাকা, মেলবোর্ন, সিডনি, লন্ডন, ম্যানচেস্টার, অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন, জোবার্গ কিংবা কেপটাউন, তাহলে কি ধন্য ধন্য অবস্থা হতো সেই শহর নিয়ে। কতজনে লিখে ফেলতেন কত কবিতা, কত গান! তৈরি হতো কত প্রামাণ্যচিত্র! কী দুর্ভাগ্য ল্যাঙ্কেস্টনের! গান-কবিতা দূরে থাক, তার নামটাও মানুষের মুখে সেভাবে শোনা যায় না!
কিন্তু তাতে কী! ক্রিকেটীয় ঔজ্জ্বল্য কিন্তু ছড়িয়েই যাচ্ছে তাসমানিয়ার এই ছোট শহর। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই শহর থেকে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছিলেন সাম মরিস। অ্যাশেজ সিরিজে একটা মাত্র টেস্ট খেলেছিলেন তিনি। তার পর আরো অনেকে খেলেছেন। অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ডেভিড বুন-রিকি পন্টিং-জেমস ফকনার এই তিনটা নাম ল্যাঙ্কেস্টন শহরের ওপর তিনটা স্টাম্প হয়ে ‘ক্রিকেট’ নামক বেলটাকে এঁটে দিয়েছেন! তিন বিশ্বকাপ ফাইনালের তিন ম্যান অব দ্য ফাইনাল! এই তিনজনই তাসমানিয়ার ক্রিকেটার। উঠে এসেছেন ল্যাঙ্কেস্টন শহর থেকে। আর তাঁদের কীর্তি তিন-তিনটা বড় শহরে তিনটা বিশ্বকাপ ফাইনালের সঙ্গে জড়িয়ে।
অস্ট্রেলিয়া প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল ১৯৮৭ সালে কলকাতায়। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেই ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের নায়ক ডেভিড বুন। তিনি তাসমানিয়ার। জন্ম সেই ল্যাঙ্কেস্টন শহরে। গোটা বিশ্বকাপে ভালো খেলেছিলেন তিনি। ৫৫ দশমিক ৮৭ গড়ে রান করেছিলেন ৪৭৭। ফাইনালে তিনি ১২৫ বলে ৭৫ রানের ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন। ল্যাঙ্কেস্টন থেকে উঠে আসা প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে একশর ওপরে টেস্ট খেলেছেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। আশির দশকে বুন-মার্শ জুটি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের পুনর্জাগরণে বড় ভূমিকা রেখেছিল অ্যালেন বোর্ডারের নেতৃত্বে। সেই ডেভিড বুন অবশ্য ওই একবারই বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর তাসমান উত্তরাধিকারী রিকি পন্টিং একবার নন, চার-চারটা বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছেন। এই জায়গায় তিনি ক্রিকেট ইতিহাসে একেবারে ব্যতিক্রমী ক্রিকেটার। চারবার ফাইনাল খেলে তিনবার চ্যাম্পিয়ন। দুবার অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে চ্যাম্পিয়ন করেছেন। ২০০৩-এ জোহানেসবার্গে ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে অপরাজিত ১৪০ রানের ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচও তিনি। তিন-তিনবার বিশ্বকাপজয়ী দলের গ্রুপ ছবিতে খুঁজে পাওয়া যায় মাত্র তিনটা মুখ। তিনজনই অস্ট্রেলিয়ান—রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আর গ্লেন ম্যাকগ্রা। তাসমানিয়ান গ্রেট পন্টিংকে অবশ্য ল্যাঙ্কেস্টন স্মরণ করে অন্যভাবেই। যদিও পন্টিংকে ক্রিকেটবিশ্ব চেনে প্রথমে অস্ট্রেলিয়ান, তার পর তাসমানিয়ান হিসেবে।
বুন-পন্টিংয়ের পাশে জেমস ফকনার খুব বড় কোনো নাম নয়। কিন্তু ক্রিকেটবিশ্বের সবচেয়ে বড় মাঠে একদিনের ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শকের (৯৩ হাজার ১১৩ জন) উপস্থিতিতে এমসিজিতে বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার নিয়েছেন তিনি। ২০১৫-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে গ্রেট শচীন টেন্ডুলকারের হাত থেকে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটা নেন তিনি। বাঁহাতি ফাস্ট বোলার আর ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের অবশ্য ফাইনালে ব্যাট হাতে মাঠে নামতে হয়নি। কিন্তু বল হাতে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন ৬ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা এই বাঁহাতি বোলার। জেমস ফকনারের বাবা পিটার ফকনারও ক্রিকেট খেলেছেন তাসমানিয়ার হয়ে। কিন্তু ছেলে যে কীর্তি গড়ল এমসিজিতে, তা তো আর তাসমানিয়া কিংবা ল্যাঙ্কেস্টনের হয়ে নয়। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ জিতলেন, ম্যান অব দ্য ফাইনাল হলেন।
ল্যাঙ্কেস্টনের মানুষ অবশ্য রসিকতা করে বলতেই পারেন, জেমস পিটার ফকনার, আপনি আমাদের জন্য নতুন কী সম্মান নিয়ে এলেন! ম্যান অব দ্য ফাইনালের পুরস্কার ল্যাঙ্কেস্টন শহরে এর আগেও দুবার ঢুকেছে!
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক