গণমাধ্যম
সম্প্রচারের ভাষা ও আচরণের দায় কার?
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার যাত্রা শুরুর সময় যখন আমি সেখানে সংবাদকর্মী হতে শুরু করলাম তখন একটা বিষয় ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলছিল। তা হলো আমি যা লিখে দেব বা দিচ্ছি তাই তো ছাপা হবে বা হচ্ছে। অফিসের অন্য কেউ কী ঘটনাস্থলে গিয়ে সেটা পরীক্ষা করে নিচ্ছেন? ১৯৯৮ সালের সেই শুরুতে সেটা বারবার ভেবেছি। আমি যদি ভুল করি, ভুল লিখি, তাহলে কী হবে? ভেবেছিলাম নতুন পত্রিকা তাই এমন হতে পারে। কিন্তু প্রথম আলো যখন সবাইকে ছাপিয়ে গেল তখনো বড় বড় হরফে আমার নামে রিপোর্ট ছাপা হতো। অবাক লাগত, কত বড় দায়িত্ব একজন মানুষের হতে পারে। একজন প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী, আমলা বা অন্য পেশার কেউ কী একটু লেখার একটু ভুলে এতবড় অন্যায় বা অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারবেন, যা এক রিপোর্টার করতে পারেন? মনে হয় না। পত্রিকায় যা লিখলাম তা তো কত হাত ঘুরে ছাপা হয়, কিন্তু টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারে রিপোর্টার যা বলছেন, করছেন তাতো আরো বড় দায়িত্বের বিষয়। সেই দায়িত্ব কী সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে? এই ডামাডোলের যুগে কতটুকুই করা যাচ্ছে?
বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা বৃদ্ধির গ্রাফিক্স করে দেখতে চাইলে চোখের পাতায় ছোটখাটো ঝড় বইতে পারে। অন্যতম রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনের তিন দশক পর ২০০০ সালে এসেছিল বেসরকারি টেলিভিশন ইটিভি। কিন্তু তার পূর্বাপর সময়টুকু কেমন ছিল? অন্তত একজন সংবাদকর্মীর মনের অনুভূতির খবর নিলে তটস্থই হতে হবে। অবশ্য তারও আগে ১৯৯২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন সংবাদ চ্যানেল সিএনএনের প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে। একই বছর বিবিসিও দেখতে পাই আমরা। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংবাদ সচেতন পাঠক, দর্শকের জানার আকাশে একুশ শতকের শুরু থেকেই এক ধরনের স্বাধীন হাওয়া বইতে শুরু করে। তবে সংখ্যার সাথে সাথে সেই স্বাধীনতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা নিয়ে কথা উঠেছে।
বিশ্বাস হয়, এত দিন পর হলেও ইটিভির খবর শুরুর সেই পুরনো মিউজিক যাকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্টিং বলে তা হঠাৎ শুনতে পেলে যে কারো কাছে কি যেন খুব পরিচিত কিছু বলেই মনে হবে। মাত্র ১৫ বছরে আমরা সেই অবস্থা থেকে অনেক দূরে, উপরে, বলা যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে এসেছি।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য অনুযায়ী, নতুন ১০টিসহ দেশে এখন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৪১। এরমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ সব সরকারের সময়ই বন্ধ হওয়া টেলিভিশনের সংখ্যাও কম নয়। যাহোক চালু আছে ২৫টি এবং আরো চালু হতে যাচ্ছে। ভিন্ন দেশের সহ বর্তমানে দেশে দেখা যায় এমন টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ২৭০ এর কাছাকাছি। যদি টেলিভিশনের সংখ্যা এভাবে বাড়ে তাহলে তার কর্মীবাহিনী বিশেষ করে সাংবাদিকের সংখ্যাও হু হু করে বেড়েছে। কোনো রকম নাটক, গান বাদে শুধু নিউজ টেলিভিশনের সংখ্যাই এখন ৬-এ দাঁড়িয়েছে। পুরো মাত্রায় আসার প্রস্তুতিতে পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে আছে নিউজ টোয়েন্টিফোর। অপেক্ষায় আছে আরো একটি। ফলে ঢাকার রাস্তায় তাকালে প্রেস স্টিকার লাগানো কী অফিশিয়াল কী ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও চোখে খটকা লাগার মতো। যে কথা বলতে চাইছি তা হলো এই যে এত এত সাংবাদিক যারা টেলিভিশনের লোগো যুক্ত মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ ৬৪ জেলায় কর্মরত সেই শত শত সাংবাদিকের কতজন তাঁর ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে সক্ষমতা অর্জন করেছেন? অথবা সক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় রয়েছেন? জানা যায়, প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন ইটিভি চালুর আগে তার সংবাদকর্মীদের টানা প্রায় ৩ মাস প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে তারপরও নাকি বিবিসির প্রশিক্ষকরা বলেছিলেন, আসলে এখনো তোমরা তৈরি নও। আরো একটু সময় লাগবে। তাদের সেই দক্ষতার প্রমাণও আমরা পর্দায় দেখতে পেতাম। তাহলে একই অথবা আরো বেশি সংবাদ প্রচারের কাজ বা দায়িত্ব নিয়ে চালু হওয়া টেলিভিশনগুলোর সাংবাদিকদের এটা লাগবে না কেন?
২৫টি টেলিভিশনের কতজন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যে ক্যামেরার সামনে কীভাবে কথা বলতে হবে? কাজটা করতেই হবে? সরাসরি সংবাদ সম্প্রচারের সময় তার কী কথা বলা উচিত হবে, কতটুকু বলতে হবে, সবক্ষেত্রে সেই নির্দেশনা দেওয়া আছে, কে বলতে পারবেন? অথবা নির্দেশনার জায়গাটিতে বসা লোকটি নিজেও প্রশিক্ষিত কি না তার খবর কে নিয়েছে? নকল ওষুধের মতো নকল বা ভুল খবরের দায়টা কীভাবে জবাবদিহির মধ্যে আসবে?
তাই, টেলিভিশনের মাইক্রোফোনের মতো শক্তিশালী ডিভাইসটি হাতে পেয়ে এরইমধ্যে সংবাদকর্মীর অনেকেই অনেক কিছু করছেন বলে নানা আলোচনা আছে। এ কথা আমাদের কতজনের মাথায় আছে যে- এটা এমন এক বিষয় ও দায়িত্ব যেখানে ভুল করলে ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, বহু জনপদ এবং রাষ্ট্র দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে? একটি টেলিভিশন থেকে অন্য একটি টেলিভিশনে যোগ দেওয়া কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক এক আড্ডায় বলছিলেন, ‘শুধু সুস্থ একটা দেহ হলেই আমার চলবে, বাকিটা আমি ঠিক করে নেব।’ ছেড়ে আসা টেলিভিশনের কর্তাব্যক্তির এমন কথায় তারা অবাক হয়েছিলেন। এ কথাটা কিন্তু ঠিক এবং তিনি এভাবেই তাঁর টেলিভিশন পরিচালনা করছেন, ব্যবসায়িক সফলতাও পাচ্ছেন। পেশা সাংবাদিকতায় এখন ব্যবসার গন্ধই বেশি। তা হোক তাতে তো কিছু মানুষের জীবন চলছে, স্বচ্ছলতাও আসছে!
কোনো প্রতিষ্ঠান, কোনো ব্যক্তি এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এখানে কিছু কথা গুরুত্বপূর্ণ- বাংলাদেশের প্রথম ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল সেই সিএসবি নিউজ থেকে এ যাবত যতবার বিবিসি ও সিএনএনের সংবাকর্মীদের কাছে প্রশিক্ষিত হয়েছি, ততবারই শিখেছিলাম যিনি খবর বলবেন, মানে পড়বেন তার মধ্যে যেন অবশ্যই একটা অথরিটির প্রকাশ থাকে। মানে শরীরের ভাষায় তার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠবে, তার বলা তথ্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে হবে। পত্রিকার পর সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য অতি জরুরি সেই শিক্ষাগ্রহণের পর প্রায় ১০ বছর হতে চলল, যা দেখছি, তাতে শুধু আফসোসই বেড়ে চলে। কোথাও কোথাও সেই সব সুন্দর সুন্দর নির্দেশনা ভেঙে চুরমার করে ফেলা হয়েছে, ফেলা হচ্ছে।
এটা যদি উপস্থাপকের বেলায় হয়ে থাকে তবে দুই মাস ধরে চলা প্রশিক্ষণে সাংবাদিক যাঁরা হবেন তাঁদের জন্য কত কথাই না ছিল। কী হবে তার পোশাক, মাঠে যাওয়ার আগেই কী ধরনের প্রস্তুতি তাঁর নিতে হবে, কেমন করে ঘাটলে কী তথ্য মিলবে, ঘটনাস্থলে তার আচার-আচরণ কেমন হবে, না হলে কী হবে, কীভাবে তিনি সর্বোচ্চ সফল হবেন আরো কত কী। সব সময় সূত্র ধরে কাজ হয়, তা আমরা দেখি না। কিন্তু সামান্য কিছু কথা বলে, আমরা যাদের এমন দায়িত্ব দিয়ে মাঠে ঠেলে দিচ্ছি তাঁরা না জানার ভুলে এক রকম করছে। আর যেসব ভুল জেনে বুঝে করছে বা করতে চাইছে তার দায় কে নেবে? পত্রিকার বানান শুদ্ধ করার মতো সুযোগ এখানে নেই ঠিক, কিন্তু ঠিক করে কথা বলাটা শুধরে দেওয়ার সুযোগ কী নেই? প্রশ্ন হচ্ছে এতগুলো টেলিভিশনে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাঁরা বসছেন বা বসানো হচ্ছে তাঁরাও কতটা যোগ্য। আগামী দিনে অনলাইন আর টেলিভিশনের যে প্রতিযোগিতা শুরু হবে সেখানে শুধু নিজের পছন্দ মতো লোক বসিয়ে কতটুকু নিরাপদে থাকা যাবে?
এসব নিয়ে ভাবার সময় চলে এসেছে বলে মনে হয়। সম্প্রচারের ভুল ভাষা ও অপ্রশিক্ষিত আচরণের নানান প্রকাশ দেখে দেখে আমরা, নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মুণ্ডুপাতও করছি। কিন্তু দূর থেকে শুধুই সমালোচনা না করে, ‘গোল্লায় গেল’ না বলে আমাদের বড়রা কি পারেন না একটু বসতে, শাসনের দায়টা নিতে? ভেতরে ভেতরে যে অনেক বড় ক্ষত তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক