চাটগাঁর কথা
বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র ও অমীমাংসিত অধ্যায়
বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্র (স্থানীয়ভাবে ‘সিটিভি’ চিটাগাং টেলিভিশন হিসেবে পরিচিত) উদ্বোধনের সময় থেকে নানা বিতর্ক নিয়ে পথচলা শুরু করে। বিশেষ করে অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন শিল্পী, কলাকুশলীদের বিরুদ্ধে নানা আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে কানাঘুষা, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে স্থানীয় এবং জাতীয় দৈনিকে। কিন্তু সে হিসেবে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।
এ অবস্থায় টেলিভিশন কেন্দ্রের মান এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়। গত বছর প্রস্তুতি নেওয়া হয়, বিটিভির পৃথক চ্যানেল হিসেবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান স্যাটেলাইট সম্প্রচারের। আজ পর্যন্ত তা-ও বাস্তবায়ন হয়নি। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএমের (জেনারেল ম্যানেজার) দায়িত্ব গ্রহণ এবং হস্তান্তর অনুষ্ঠানে দুই কর্মকর্তাকে জড়িয়ে তর্কবিতর্ক, হৈচৈ, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ইত্যাদি ‘টক অব দ্য সিটি’-তে পরিণত হয়, যা পরদিনের স্থানীয় পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়।
পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৯ মে ‘সিটিভি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টেলিভিশন কেন্দ্রে আয়োজন করেন নতুন জিএমের বরণ ও পুরোনো জিএমের বিদায় অনুষ্ঠান। এতে বিদায়ী জিএম জাঁ-নেসার ওসমানের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত জিএম মনোজ সেনগুপ্ত। একপর্যায়ে নতুন জিএমকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়েই অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে যান বিদায়ী জিএম।
গত বছরের ২০ নভেম্বর বিটিভির পরিচালক (উন্নয়ন) জাঁ-নেসার ওসমান চট্টগ্রাম কেন্দ্রে জিএম হিসেবে দায়িত্ব পান। ছয় ঘণ্টা সম্প্রচারে যাওয়ার লক্ষ্যে তাঁকে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে বিশেষ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতি মাসে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়। সম্প্রতি বিটিভির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনোজ সেনগুপ্তকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ৭ মে চট্টগ্রামে আসেন।
বিদায় ও বরণ অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে মনোজ সেনগুপ্ত জাঁ-নেসার ওসমানের কাছে টেলিভিশনের তিনটি ক্যামেরা এবং দুই কোটি টাকার হিসাব চান। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথি আসন থেকেও কয়েকজন নাকি জাঁ-নেসার ওসমানের কাছে ক্যামেরার বিষয়ে জানতে চান বলে পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়। এভাবে হৈচৈ শুরু হলে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়েই অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে যান জাঁ-নেসার ওসমান।
প্রতিবেদনে দুই কর্মকর্তার বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এতে নতুন জিএম মনোজ সেনগুপ্ত বলেন, ‘দায়িত্ব হস্তান্তর করতে গেলে একটি ফরম্যাট থাকে; সরকারি কিছু নিয়মকানুন থাকে। সেই নিয়ম মানা হয়নি। বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ৪০ লাখ টাকা মূল্যমানের তিনটি ক্যামেরা এখনো ওনার কাছে। চার মাস ধরে ক্যামেরাগুলো বাইরে। অথচ নিয়ম হচ্ছে, অনুষ্ঠান নির্মাণের স্বার্থে কেউ যদি সকালে ক্যামেরা নিয়ে যায়, সেগুলো সন্ধ্যায় আবার বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। কারো বাসায় মাসের পর মাস ক্যামেরাগুলো রেখে অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। এই ক্যামেরাগুলো উনি বুঝিয়ে দিতে পারেননি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ক্যাসেটও বুঝিয়ে দিতে পারেননি। দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় এসব বুঝিয়ে দিতে বললে উনি চলে যান।’
জাঁ-নেসার ওসমান প্রতিবেদনে ওই দিনের ঘটনায় তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন, ‘হঠাৎ বাইরে থেকে আসা কিছু লোক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং হৈচৈ শুরু করে। তখন আর দায়িত্ব হস্তান্তরের মতো পরিবেশ না থাকায় দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়েই চলে আসি। পরে আমি মাননীয় তথ্যমন্ত্রীকে ফোন করলাম। মন্ত্রী বললেন, চট্টগ্রামে জিএম নিয়োগের বিষয়ে তিনি অবগত নন।’
তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে প্রসঙ্গে বলেন, ‘টেলিভিশন কেন্দ্রে ইনডিভিজ্যুয়ালি প্রোডিউসর আছেন। ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তাঁদের। আমি অনুমোদনকারী মাত্র। যারা নিয়ে গেছে, তারা নিয়ে যাওয়ার সময় ফেরত দেবে বলেছে। এখন ওদের বিষয়টি জিএমের ওপর কেন আসবে?’ দুই কোটি টাকা বিষয়ে বলেন, ‘৬৬ লাখ টাকা তো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ছিল। অনুষ্ঠান নির্মাণের যে ব্যয়, সেগুলো তো চেকের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। প্রোগ্রাম ম্যানেজার আছেন। এখানে তো স্বচ্ছতা আছেই।’
দুই কর্মকর্তার বাকযুদ্ধের ঘটনার পর আর কোনো নতুন খবর পাওয়া যায়নি। তবে একেকবার একেকজন নতুন কর্মকর্তার আগমনকে কেন্দ্র করে শিল্পী-কুশলীদের ভিন্ন ভিন্ন দলের প্রাধান্য বেড়ে যায়। এবারেও সে রকম পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বিটিভি সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। এর পর থেকে এখানে প্রতিদিন পাঁচ মিনিটের সংবাদ বুলেটিনসহ এক ঘণ্টা ৩০ মিনিটের স্থানীয় অনুষ্ঠান সম্প্রচার হচ্ছে। ২০১০ সালের ৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতু উদ্বোধনকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ২০১২ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর লক্ষ্য ছিল বর্তমান দেড় ঘণ্টার সম্প্রচারের পরিধি বাড়িয়ে ছয় ঘণ্টা করে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল টিভি কেন্দ্র স্থাপন।
গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ছয় ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার উদ্বোধনের দিন নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বিশেষ মঞ্চ থেকে অথবা ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধন ঘোষণা করার। গত বছরের ৮ আগস্ট ছয় ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার-সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জানা যায়, চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু চট্টগ্রাম টিভির স্যাটেলাইট সম্প্রচারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের ব্যাপারে টেলিভিশন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে আবারও ঘোষণা দেন; কিন্তু তা-ও বাস্তবায়ন হয়নি।
জানা গেছে, স্যাটেলাইট সম্প্রচারের সম্পূর্ণ উপযোগিতা রয়েছে কেন্দ্রটির। কিন্তু বিটিভি ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে সবুজসংকেত না মেলায় তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এ প্রসঙ্গে বিটিভি চট্টগ্রামের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, স্যাটেলাইটে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। এখনই সম্প্রচারে যাওয়ার মতো প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু ঢাকা কেন্দ্র থেকে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায়নি, তাই সম্প্রচার সম্ভব হচ্ছে না।
বিটিভির প্রকৌশল বিভাগের সূত্রমতে, চট্টগ্রাম কেন্দ্র স্যাটেলাইট সম্প্রচারে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। এ জন্য তেমন বাড়তি জনবলের প্রয়োজন নেই। কোনো পয়সা খরচ করতে হবে না। চট্টগ্রাম কেন্দ্রে স্থাপিত আর্থ স্টেশনের মাধ্যমে খুব সহজেই স্যাটেলাইট সম্প্রচার সম্ভব। কিন্তু টেরেস্টিরিয়াল পদ্ধতির জন্য পাঁচটি টাওয়ার বসাতে হবে নতুন করে।
কিন্তু ছয় ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচার টেরেস্টিরিয়াল পদ্ধতিতে চালানোর ব্যাপারে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের একটি পক্ষ জোর দিচ্ছে। তারা বলছে, স্যাটেলাইটে অনুষ্ঠান চালানোর মতো স্থায়ী জনবলের ঘাটতি রয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রে। মূলত এই বিরোধের কারণে ছয় ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার কার্যক্রম থমকে আছে বলে জানা গেছে।
ছয় ঘণ্টার অনুষ্ঠান সম্প্রচারের প্রস্তুতি হিসেবে গত বছরের ২৭ আগস্ট স্থানীয় কেবল অপারেটরদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন বিটিভির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী।
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর বিটিভির মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে ছয় ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার-সংক্রান্ত পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো প্রযোজকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আয়োজক প্রথা থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত বছরের ২৫ নভেম্বর বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রে ছয় ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার-সংক্রান্ত প্রস্তুতি সভায় ১০ অক্টোবরের মধ্যে দুই মাসের অনুষ্ঠান তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সভায় জনবলের বিষয়ে বিটিভির পরিচালক (প্রশাসন) ও পরিচালক (অর্থ) জানান, সম্মানী খাতের চার কোটি টাকার সমন্বয় করে অস্থায়ীভাবে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা যাবে। অতিরিক্ত কোনো বাজেট অর্থ বিভাগ থেকে আনার প্রয়োজন হবে না।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক পূর্বকোণ।