ক্রিকেট
কাটার মুস্তাফিজ বাংলার গর্ব
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পদচারণা ঠিক এক বছর। এক বছর আগেও যাকে একজন সাধারণ ক্রিকেটারই বলা যেত। তিনি আজ বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাণ ভোমরা। খুব বাড়িয়ে বলছি কি না জানি না, তবে সে বিশ্ব ক্রিকেটেরও এক উদীয়মান মহাতারকা! যেভাবে বোলিংটা করে চলেছেন ঠিক এভাবে চলতে থাকলে, পুরো ক্রিকেট বিশ্ব তাঁকে নিয়ে যে মেতে থাকবে সে আলামত এরইমধ্যে মিলেছে। সম্প্রতি আইপিএলে ধারাবাহিক পারফরমেন্স বলে দিচ্ছে আগামীর বিশ্ব ক্রিকেটে যে কজন বোলার-ব্যাটসম্যানকে শাসন করবে নিশ্চিতভাবে তাদের প্রথম সারিতে হবে তাঁর স্থান। তাঁকে নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। আর এটা নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনাই নাই। এই দেখুন, ভারতীয় কমেন্টররা কিন্তু বাংলাদেশি খেলোয়াড়দেও প্রশংসা করতে একটু সংকোচ বোধ করে। অথচ এই দেশীয় মুস্তাফিজ এখন তাদের পূজার পাত্র হিসেবে মূল্যায়ন পাচ্ছেন।
ক্রিকেটীয় মেধা, বিনয় ও ব্যক্তিত্বের সাথে মানিয়ে যাওয়া সব আচরণ যেন ক্রিকেটের বাইরে আলাদা করে চিনিয়েছে মুস্তাফিজকে। উইকেট পেলে ওর ছেলেমানুষি উদযাপন দেখলে বোঝা যায় ওর সরলতা। কিন্তু বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের কাবু করতে গেলে ওর চেহারাই পাল্টে যায়। এক কথায় অনন্য ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ ক্রিকেটীয় মেধা আমাদের কাটার মুস্তাফিজ! সারা বাংলা যাকে নিয়ে গর্ব করে চলেছে।
সম্প্রতি আইপিএলে তাঁর দায়িত্বের ব্যাপারে সে শতভাগ নিবেদিত। ‘সেসব সময়’ বলছে, ‘নো প্রবলেম বোলিং, টকিং অ্যান্ড ব্যাটিং প্রবলেম!’ ব্যাটিংটা তাঁর দায়িত্ব নয় সুতরাং ওটাতে প্রবলেম হতেই পারে। কিন্তু ক্রিকেটে ‘টকিং’ নামে কিছু আছে বলে মনে হয় না যেটা নিয়ে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আজকাল এই ‘টকিং’ জিনিসটাতে মুস্তাফিজ বেশি আলোচিত! তাঁর বোলিং নিয়ে আলোচনার চেয়ে তাঁর ‘টকিং’ বেশি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমগুলোতে। মুস্তাফিজ যে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না! আর এটার জন্য একটু সমস্যায় পড়তে হলেও তাঁকে ইংরেজি শিখতে যেতে হয়নি। উল্টো তার সাথে যোগাযোগ করতে তাঁর সতীর্থরা বাংলা শিখছেন। ফেসবুক, টুইটারে তাঁকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন বড় তারকারা। স্বয়ং হায়দরাবাদের অধিনায়ক ওয়ার্নার বাংলা শিখতে চলেছেন মুস্তাফিজের জন্য! কমেন্ট্রি বক্সে তাঁকে নিয়ে মজেছেন কমেন্টররা। কেউ বলছেন দুর্দান্ত, দুর্বোধ্য আবার কেউ বলছেন অসাধারণ ক্রিকেটীয় প্রতিভা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন মুস্তাফিজুর রহমান।
এখন সেই বিস্ময়ের ঘোরে আক্রান্ত আইপিএল! মুস্তাফিজ-ধাঁধার তল খুঁজে পাচ্ছেন না কেউই। আইপিএলে মাত্র পাঁচ ম্যাচ খেলেই বাংলাদেশের এই বাঁ-হাতি পেসার নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তার জন্য জুতসই কোনো বিশেষণ খুঁজে পাচ্ছেন না ধারাভাষ্যকাররা।
সানরাইজার্স হায়দরাবাদের জার্সি গায়ে প্রতি ম্যাচেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া মুস্তাফিজ এখন গোটা আইপিএলেরই থিম সং। চারদিকে ধন্যধন্য পড়ে গেছে। সেটাই স্বাভাবিক। আইপিএলে এখন পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচে ১৬.৪২ গড়ে সাত উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজ। ওভারপ্রতি রান দিয়েছেন মাত্র ৫.৭৫ করে। মুস্তাফিজকে পাল্টা আক্রমণ করার চেয়ে তার ধাঁধার জবাব মেলাতেই বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় ব্যাটসম্যানদের। শনিবার পাঞ্জাবের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো জাদুকরী বোলিং মুস্তাফিজের সামর্থ্যের আরেকটি প্রমাণমাত্র। প্রথম ৯ বলে কোনো রান না দিয়ে তাঁর উইকেট তুলে নেওয়ার ঘটনাটিও আইপিএলের ইতিহাসে প্রথম ঘটল। প্রথম ১২ বলের ১১টিই ডট। তিন ওভার শেষেও নামের পাশে রান মাত্র তিন। ইনিংসেও নিজের শেষ ওভারে দিলেন ছয় রান, নিলেন আরো এক উইকেট। সব মিলিয়ে মাত্র নয় রানে দুই উইকেট।
আইপিএলে হায়দরাবাদের প্রতি ম্যাচেই ভাষ্যকারদের একটা দীর্ঘ সময় থাকে তাঁকে নিয়ে। প্রতি ম্যাচ শেষে কোচ-অধিনায়ককেও আলাদা করে বলতে হয় মুস্তাফিজকে নিয়ে। এ মুহূর্তে মুস্তাফিজকে নিয়ে নতুন কিছু বলাও কঠিন চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন বলতে বলতে বিশেষণও তো ফুরোয়, কিন্তু মুস্তাফিজের বিস্ময় যে ফুরোচ্ছে না!
পুরো দলই তাঁকে নিয়ে মজেছে। হায়দরাবাদ সানরাইজার্সের অফিশিয়াল টুইটার থেকে টুইট করা হয়েছে, ‘ম্যাজিকাল? মিস্টেরিয়াস? ম্যাগনিফিসেন্ট? আমরা তো আমাদের তারকা খেলোয়াড় মুস্তাফিজের জন্য বিশেষণের সংকটে পড়ে যাচ্ছি!’ অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার বলেছেন, মুস্তাফিজের মতো প্রতিভা খুব কম দেখা যায়। বাংলাদেশের সৌভাগ্য, এই প্রতিভা অন্য কোনো দেশ নয়, পেয়েছে বাংলাদেশ।
ওয়ার্নারের ভাষায়, ‘ভিন্ন ভিন্ন গতিতে বল করতে পারা আর বিভিন্ন গোপন অস্ত্রের ব্যবহার- এক কথায়, অসাধারণ! মুস্তাফিজের মতো প্রতিভা পেয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতেই পারে।’ মুস্তাফিজের সৌজন্যে বাংলা ভাষাও এখন ক্রিকেট মহলে আলোচিত। পরশু যেমন ম্যাচসেরার পুরস্কার নিতে গিয়ে বেশ সাবলীল বাংলাতেই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দিলেন এই বাঁ-হাতি তরুণ পেসার। মুস্তাফিজের জন্য এখন বাংলা শেখার ধুম পড়েছে। শুরুটা তাঁর কোচ ও অধিনায়কই করেছিলেন। হায়দরাবাদের অনেক অবাঙালি সমর্থকও এখন বাংলায় দু’একটি শব্দ পোস্ট করার দিকে ঝুঁকছেন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।
কোচ টম মুডি ইন্সটাগ্রামে একটা ছবি পোস্ট করেছেন। মুস্তাফিজের মুখে কেক মাখিয়ে দিচ্ছেন হায়দরাবাদের মেন্টর ভিভিএস লক্ষ্মণ। সেটারই ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘ফিজের জন্য কেক উদযাপন। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার জন্য মুস্তাফিজ তোমাকে অভিনন্দন। কী অসাধারণ পারফরম্যান্স!’ সমস্যা একটাই ইংরেজি ভাষাটা এখনো রপ্ত করতে পারেননি মুস্তাফিজ। তাতে অবশ্য সমস্যা হচ্ছে না। ওয়ার্নার জানালেন, কাজ চালানোর মতো ইংরেজিতে তাকে ঠিকই ভরসা জোগান মুস্তাফিজ। কিন্তু ইংরেজি না শেখাটাই মনে হয় ভালো মুস্তাফিজের জন্য। মুস্তাফিজ সারা বিশ্বে খেলে বেড়াবে; আর বাংলা ভাষা শেখার জন্য সবাই চেষ্টা করবে। এতে আমাদের ভাষা বিশ্বব্যাপী পরিচিত হবে। ক্রিকেট নিয়ে দেশের জনগণ তখন আলাদা করে গর্ব করতে পারবে। শুধু ক্রিকেট খেলেই আমরা খান্ত নই। ভাষাটাকেও ছড়িয়ে দিতে পারছি এর চেয়ে বড় কী হতে পারে? যে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছিলাম সে ভাষা আজ ক্রিকেটের জন্য আরো একবার সমাদৃত।
সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে- মুস্তাফিজ যেন কোনো ক্রিকেটীয় চক্রান্তের শিকার না হন। এ দেশের গর্ব কাটার মুস্তাফিজসহ বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে যাক। সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
লেখক : প্রতিনিধি, দ্য ডেইলি সান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।