স্মৃতিতে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি
তিন বছর আগের মনুষ্যসৃষ্ট চরম মানবিক বিপর্যয় আর ভয়াল সেই দিনগুলোর কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। বৈশাখের তীব্র গরমে নয়তলা ভবনের ভেতরে হাজার হাজার মানুষের আর্তনাদ, কেউ বাঁচার জন্য কেউ বা আবার শুধুমাত্র এক ফোঁটা পানির জন্য।
ভবনের বিভিন্ন স্থানে একদিকে যেমন বাঁচার আকুতি, অন্যদিকে চোখে পড়ছিল চাপা পড়া অবস্থায় কারো মাথা, কারো পা, কারো আবার খণ্ডিত শরীর। চোখের সামনেই দেখেছি, ভবনের কংক্রিটের মাঝে মিশে আছে শ্রমিকের নিথর দেহ।
আর বিধ্বস্ত প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতরে কোনো প্রাণের সন্ধান খুঁজে পাওয়া মাত্রই উদ্ধারকর্মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টায় আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছেন। আর শত শত মানুষ তখন ছুটছিল অ্যাম্বুলেন্সের পেছন পেছনে, স্বজনের সন্ধানে।
সংবাদকর্মীসহ অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষের চোখে-মুখে তখন আনন্দের ছাপ। কারো আবার চোখের জল আর মুখের হাসি মিলেমিশে একাকার।
জীবিত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে আপনজনের খোঁজে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে স্বজনরা ছুটে গিয়েছেন স্থানীয় এনাম মেডিকেল পর্যন্ত। আর কোনো মরদেহ পাওয়া গেলে আশঙ্কা নিয়ে সেটি শনাক্ত করতে সেই অধরচন্দ্র স্কুল মাঠ পর্যন্ত ছুটেছেন নিঁখোজ থাকা শ্রমিকদের স্বজনরা।
উদ্ধারকর্মী, এলাকাবাসী আর স্বেচ্ছাসেবকরা ভবনের বিভিন্ন স্থান থেকে অক্সিজেন, পানি, কাটার, জুস, দড়ি, টেপ, টর্চলাইট, পাইপ, কাগজ, কাপড়সহ প্রযোজনীয় সাহায্য চেয়ে প্লাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ভূমিকা ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পাশাপাশি উদ্ধার তৎপরতায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আসলেই জাতিকে প্রেরণা দিয়েছে।
জাতি যখন গণজাগরণ মঞ্চ আর হেফাজতে ইসলাম- এই দুই ভাগে বিভক্ত, তখন তাদেরও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এসে উদ্ধার তৎপরতায় অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে আমরা যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক।
দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকৃতদের কাতারে জীবিত মানুষের চেয়ে মৃতের সংখ্যাই ছিল বেশি। তাই হয়তো এনাম মেডিকেল কলেজের চেয়ে অধরচন্দ্র স্কুলের মাঠে মানুষের ভিড়ও বাড়তে থাকে সময়ের ব্যবধানে।
তিন বছর কেটে গেছে। এখনো যতবার সাভার বাসস্ট্যান্ড পার হই, ততবারই এমন সব হাজারো স্মৃতি মনের ভেতরে জ্বলজ্বল করে, চোখ ছলছল করে ওঠে। এখনো যেন আহতদের চিৎকার, নিহতের বীভৎস নিথর দেহ আর অপেক্ষমাণ স্বজনদের কান্না চোখের সামনে দেখতে পাই।
প্রিয়জনের স্বজনহারা আর্তনাদ আর বাতাসে লাশের গন্ধ এখনো পাই- রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির কথা মনে পড়তেই।
লেখক : সিনিয়র করেসপনডেন্ট, এনটিভি