প্রকৃতি
আমাদের সুন্দরবন এবং ধরিত্রী রক্ষায় বৃক্ষ
সুন্দরবন আমাদের দেশের গর্ব। এটি শুধু এখন আর আমাদের বাংলাদেশেরই সম্পদ নয়, তা এখন বিশ্ব ঐতিহ্য অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। পৃথিবীর একমাত্র এবং সবচেয়ে বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। একক হিসেবে সুন্দরবন যেমন বৃক্ষের চাহিদা পূরণ করছে, ঠিক তেমনিভাবে একে উপলক্ষ করে শত-সহস্র মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে। সেখানে প্রাকৃতিকভাবেই পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষিত হয়। তা ছাড়া বঙ্গোপসাগরের তীরে একটি বিরাট এলাকাজুড়ে তা বিস্তৃত থাকায় সমুদ্রের অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশকে রক্ষা করে থাকে। কিন্তু সেই সুন্দরবনে দুই মাস ধরে শুরু হয়েছে আরেক নতুন ষড়যন্ত্র। কে বা কারা সেখানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সেই বনকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই মার্চ ২০১৬ এবং এপ্রিল ২০১৬ তারিখে দুই মাসে সুন্দরবনের কয়েকটি স্থানে কমপক্ষে চারবার আগুন লাগানো হয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বিগত ১৪ বছরে সুন্দরবনে কমপক্ষে ২০টির বেশি ছোট-বড় আগুন লেগেছে। জীববৈচিত্র ধ্বংস করার অংশ হিসেবে সেখানে মৌয়ালরা অবৈধভাবে মধু সংগ্রহ করে, মৎস্যজীবীরা অবৈধভাবে মাছ শিকার করে, শিকারিরা অবৈধভাবে বাঘ, হরিণ, পাখিসহ অন্যান্য পশু-পাখি শিকার করে বনের সৌন্দর্য এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করছে অবিরত। অথচ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার জন্য গত ২২ এপ্রিল পালিত হয়ে গেল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। এবারের ধরিত্রী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘ধরিত্রীর জন্য বৃক্ষ’। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস ও অধিক আগ্রাসী বৃক্ষ রোপণের কারণে দেশে গাছের বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। বৈচিত্র্য হারানোর ফলে এসব গাছের ওপর নির্ভরশীল উদ্ভিদ ও প্রাণিরা হারিয়েছে আশ্রয় ও খাদ্য। কাজেই প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, গাছের বৈচিত্র্য হারালে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। এতে ভেঙ্গে পড়তে পারে প্রতিবেশের খাদ্যজাল। মারা পড়তে পারে কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, মাছ, পাখিসহ অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিকূল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের জরিপে দেখা গেছে, শুধু প্রাকৃতিক বনে বিলুপ্তির পথে রয়েছে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ। এর মধ্যে গুল্ম থেকে শুরু করে বৃক্ষ পর্যন্ত রয়েছে। অন্যদিকে বৃক্ষ রোপণের নামে আগ্রাসী গাছ রোপণের ফলে বৃক্ষের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা তৈরির ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। কারণ এসব জেলায় গত কয়েক বছরে সামাজিক বনায়ন থেকে শুরু করে মহাসড়কের দুই পাশে, জেলা সড়ক, বসতবাড়ি, নদী, খাল, এমনকি ক্ষেতের আইলসহ সর্বত্র ইউক্যালিপটাস গাছে ছেয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্যালিপটাস গাছের কারণে শুধু পাখিদের আশ্রয়স্থল কমে গিয়ে খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে না বরং অন্য প্রাণীরাও আশ্রয় ও খাদ্যাভাবে পড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেখা গেছে, ইউক্যালিপটাসের পাশাপাশি দেশের বনভূমিতে আকাশমনি, সেগুন, কড়ই গাছের একক বাগান গড়ে উঠেছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রতিটি স্থানীয়জাতের বৃক্ষকে আশ্রয় করে কমপক্ষে ১২ প্রজাতির পাখি বসবাস করে থাকে। কাজেই বৃক্ষ বৈচিত্র্য হারানোর সাথেসাথে এসব প্রজাতির প্রাণিগুলো ঝুঁকির মুখে পড়ছে সবসময়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিরন্তর উদ্যোগের অংশ হিসেবে সম্প্রতি সুন্দরবন সুরক্ষায় (স্পেশাল মনিটরিং এনালাইজিং অ্যান্ড রিপোর্টিং টুলস) ‘স্মার্ট’ প্যাট্রলিং টিম গঠন করেছে বন অধিদপ্তর। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় এবার সর্বাধুনিক এ পদ্ধতির প্রবর্তন করা হলো।
আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জেই শুরু হবে এ পদ্ধতিতে প্যাট্রলিং। প্যানথেরা নামের আন্তর্জাতিক একটি কোম্পানির প্রস্তুতকৃত এ সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির টুলস এটি। বনের সংরক্ষিত এলাকা মনিটরিং, তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্টিংয়ে এ টুলস এখন পর্যন্ত বিশ্বের সর্বাধিক প্রশংসিত একটি প্রযুক্তি। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন প্রজেক্ট’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় স্মার্ট প্যাট্রলিং টিম গঠন করা হয়েছে। ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সুন্দরবন বিভাগের কিছু মধ্যম সারির কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
গত ৯ ও ১০ মার্চ বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেনস বার্নিকাট এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সুন্দরবন সফরকালে এই স্মার্ট প্যাট্রলিং ব্যবস্থার প্রদর্শনীর মহড়া সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। জানা গেছে, বিশ্বের ৩১টি দেশের ১৪০টির বেশি স্থানে চালু রয়েছে স্মার্ট প্যাট্রলিং পদ্ধতি। এর মধ্যে ২০১৫ সালের এশিয়ার ১২টি জেডএসএল (জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন) সাইটে ১২ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রয়োগ করা হয়েছে এ পদ্ধতি। পাশাপাশি আফ্রিকায় আট হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার ১০টি সাইটে প্রয়োগের পর এখন এর বাস্তবায়ন এলাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারে। এ দুটি মহাদেশে বাঘ, হাতি ও সিংহসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণি ও বনজ সম্পদ রক্ষায় স্মার্ট প্যাট্রলিং পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে।
ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ডের বনাঞ্চল ও জাতীয় উদ্যানগুলোর জেডএসএল সাইটে স্মার্ট প্যাট্রলিং পদ্ধতির ব্যবহার জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব টিমের কাজের জন্য প্রতিটি টিমের জন্য থাকবে দুটি করে লঞ্চ, ওপেন টাইপ স্পিডবোট, ফাইবার বডি ট্রলার এবং প্রয়োজনে বিশেষ সময়ে থাকবে একটি কেবিন ক্রুজার। চারটি রেঞ্জের প্রতিটিতে তিনটি করে টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি দলে থাকছেন ১৬ জন করে সদস্য। প্রথম দুটি দল পালাক্রমে ১৫দিন পরপর সুন্দরবনের প্রতি রেঞ্জে দায়িত্ব পালন করবে আর তৃতীয় দলটি রিজার্ভ হিসেবে থাকবে। অত্যাধুনিক এসব ব্যবস্থা যেকোনো পরিস্থিতিতে সুন্দরবনের ওপর সবধরনের আগ্রাসন বন্ধে ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বাংলাদেশ পরিবেশের বিষয়টিকে অনেক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে সবসময়। তার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন। সম্প্রতি পানি নিয়ে জাতিসংঘ প্যানেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গত বছরের (২০১৫) ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর জন্য গৃহীত বাধ্যবাধকতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে ১৭০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি দল সেখানে গিয়ে এরইমধ্যে ২২ এপ্রিল চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করেছে। কাজেই বৃক্ষ রক্ষা করতে পারলেই সুন্দরবন রক্ষা পাবে, আর সুন্দরবন রক্ষা পেলেই পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার মাধ্যমে ধরিত্রীও রক্ষা পাবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।