১৯৭১
অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্ত দেশে
বাংলাদেশ নামক একটি দেশ প্রতিষ্ঠার দাবি শুরু হয় ১৯৬৬ সালে ‘ছয় দফা’ আন্দোলনের মাধ্যমে। জাতীয় সংসদে শতকরা ৫৬ ভাগ থাকার পর সরকারি চাকরিতে বৈষম্য করা হচ্ছিল। এ দেশের মাত্র পাঁচ ভাগ মানুষকে সরকারি চাকরি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দ না দিয়ে মনগড়া বরাদ্দ দেওয়া হতো। আমাদের দাবি ছিল, বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে জাতীয় বরাদ্দ দিতে হবে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা তুলে ধরা হলে আইয়ুব খান ঘোষণা দিল অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে। এর মধ্যে ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় আইয়ুব খানের। মামলা থেকে তাঁকে মুক্ত করে ছাত্রসমাজ শেখ মুজিবুর রহমানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়।
এরই মধ্যে সারা দেশে ছয় দফা বাস্তবায়ন অথবা এক দফা (স্বাধীনতা) দাবি করা হয়। পরে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর ইসলামাবাদে গোলটেবিল বৈঠকে ছয় দফা পাশের দাবি জানানো হয়। বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের আলোচনা চলতে থাকল। ছয় দফার বিষয়ে আমরা আপসহীন থাকলাম। এরই মধ্যে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তিনি মার্শাল ল’ জারি করেন। আমরা ৫৬ ভাগ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দসহ সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব দিলে ইয়াহিয়া খান আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন পাচ্ছিলাম না। পরে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া হলো। নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে আমরা জয়লাভ করলাম। এতে ভুট্টো আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। নির্বাচনে জয়লাভের পর ভুট্টো আর সংসদীয় অধিবেশন ডাকেন না। এতে সংসদ সদস্যরা একত্রিত হয়ে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে করণীয় সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলাম।
অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি সভা ডাকা হলো। সেখানে ঘোষণা হলো ছয় দফার বাস্তবায়ন অন্যথায় এক দফা (স্বাধীনতা)। অবশেষে চাপের মুখে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশনের ঘোষণা দিলেন। আমরা সংবিধান তৈরির জন্য চেষ্টা করলাম। এরই মধ্যে ২৯ ফেব্রুয়ারি আমরা গোপন সূত্রে জানতে পারলাম অধিবেশন মুলতবি করা হবে। পরে রেডিওতে ১ মার্চ বলা হয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন মুলতবি করা হলো। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। বিকেলে হোটেল পূর্বাণীতে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা অসহযোগ আন্দোলন করব। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত।’ ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে পূর্ণ দিবস হরতাল পালনের ঘোষণা করা হলো। একই সাথে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় তিনি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার সাথে সাথে ট্রেন, বিমান, জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাংক-বীমা অফিস-আদালত সব কিছুর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ল। অবস্থা দেখে মনে হয় যেন এ ধরনের ঘোষণার জন্যই অপেক্ষা করছে বাংলার মানুষ। সরকারি চাকরিজীবীরা রাস্তায় নেমে এলো। কিন্তু হাসপাতাল, খাদ্যগুদাম, থানা খোলা রাখা হলো। এ সময় একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হলো। অতিরিক্ত সচিব সানাউল হকের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিজীবীরা এসে ঘোষণা দিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকারি অফিস-আদালত চলবে।
এ সময় পূর্ব বাংলার সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চলছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগুলো এমনভাবে পালন করছে যে, পাট রপ্তানির দায়িত্বে থাকা শ্রমিকরা পাট রপ্তানি বন্ধ করে দিল। প্রেসিডেন্টের ঘরে রান্না পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলার মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে সর্বত্র আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এ সময়টা এককথায় পূর্ব বাংলা সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চলছে। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। অবশ্য অন্যায়কে প্রতিরোধ করা যে বাঙালির ঐতিহ্য, তার প্রমাণ ওই সময় আমরা পেয়েছি। এই ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এবং ১৯৫৮ সালে দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আইয়ুবের মাশাল ল-এর প্রতিবাদের মাধ্যমে। এ সময় ছাত্রসমাজ তাঁর শাসনব্যবস্থাকে এমনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আইয়ুবের কাছ থেকে ডিগ্রি গ্রহণ করেনি। এ কারণে ওই সব ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশে আসেন। সর্বক্ষণ খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। অবশেষে ৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশ্বাসের পাশাপাশি ঘোষণা করলেন ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে। ৬ মার্চ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও আমাকে ৭ মার্চ ভাষণের খসড়া তৈরির নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় আমার বন্ধু এম আমীর-উল ইসলামও আমাদের সাথে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন এমনভাবে ভাষণ দিতে হবে যেন, আর্মিরা সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ না চালায়। আমরা যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করি তাহলে আর্মিরা হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে। এরই মধ্যে ৭ মার্চ দুপুরের পর শুরু হলো বক্তব্য। এ সময় হাইকোর্টের প্রাঙ্গণে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদের ওপর পাক আর্মিরা মেশিনগান তাক করে বসে আছে। যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়, তাহলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমনভাবে কৌশলে বক্তব্য দিলেন সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল এবং এ এলাকার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে চলে এসেছে। এ অবস্থায় পশ্চিমারা পাগল হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা সাংবাদিকরা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন এটার সমাধান কী? আমি উত্তরে বললাম, দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো স্বাভাবিক পথ, অর্থাৎ ছয় দফা দাবি মেনে নেওয়া অন্যটি হলো অস্বাভাবিক পথ, অর্থাৎ যুদ্ধ। তবে মনে হচ্ছে পাক বাহিনী অস্বাভাবিক পথ বেছে নিচ্ছে। এদিকে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। তাঁর কাছে সংবিধানের খসড়া পেশ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান নীরব থাকেন এবং সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন শুরু করে। এ ছাড়া আমরা জানতে পারলাম জাহাজে ও বিমানে করে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যরা অবতরণ করছে। দেখতে দেখতে ২৫ মার্চ এসে গেল। সারা দেশে যেন একটা আতঙ্কের ছাপ। মানুষ বুঝতে পারছে দেশে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
অবশেষে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু দলের নেতা-কর্মীদের আত্মগোপনে চলে যেতে বললেন। আমি এবং আমীর-উল ইসলাম একত্রে তাজউদ্দীনের ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোডের বাসায় গিয়ে তাঁর বাড়িতে উঠলাম। রাত ৮টার দিকে তিনি তাঁর প্রতিবেশী এম আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে যখন সাত মসজিদ রোডের দিকে যাচ্ছিলেন তখনই তাঁরা খবর পান যে রাস্তায় রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গাছ কেটে ব্যারিকেড বসিয়েছে। এই সময় মোজাফফর নামের কুমিল্লার এক সংসদ সদস্য আমাদের জানান যে নিউমার্কেটের সামনে ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) অবস্থান নিয়েছে। ফলে পুরান ঢাকায় না গিয়ে আপাতত ধানমণ্ডির আশপাশে আত্মগোপনের উদ্যোগ নিলাম। এ সময় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে যাই। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যাওয়ার পর দেখলাম বঙ্গবন্ধু রাতের খাবার খাচ্ছেন। আমরা গিয়ে তাঁকে আত্মগোপনের কথা বললে তিনি অস্বীকার করেন। একই সাথে আমাদের দ্রুত আত্মগোপনে যেতে বলেন। আমরা লালমাটিয়ার কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি তাজউদ্দীন ভাইকে বললাম, আমরা সবাই একসঙ্গে থাকা ঠিক হবে না। রাতের পরিস্থিতি বুঝে আলাদাভাবে থাকার পর সকালে নদী পার হয়ে ঢাকা থেকে বের হয়ে যাব। অবশেষে তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলামকে বিদায় দিয়ে আমি লালমাটিয়ায় এক আত্মীয়র বাসায় উঠলাম। পরের দিন আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা আমাকে ছেড়ে চলে যান। পরে চারদিন বাড়ি পরিবর্তন করে থাকার পর লালমাটিয়ায় একটি বাসা থেকে ৩০ মার্চ আমাকে আটক করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। সন্ধ্যার সময় আমাকে আটক করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক আর্মি অফিসার আমাকে বলেন, ‘তোমার নেতাকেও এই জায়গায় রাখা হয়েছিল। তুমিও এখানে থাক।’ প্রথম বুঝতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে একদিন রাখার পর ৩১ মার্চ বা ১ এপ্রিল আমাকে একটি বিমানে করে প্রথমে করাচি পরে ইসলামাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাওয়ালপিন্ডি কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে রাখা হয়। কারাগারে একটি লকআপে শুধু আমি একাই ছিলাম। পরে সেখান থেকে হরিয়ানাপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্জন একটি কক্ষে আমাকে রাখা হয়। যেখানে গার্ডদের সঙ্গেও কথা বলা নিষেধ ছিল আমার। এ সময় একটি রুটি ও ডাল দেওয়া হতো খাবার হিসেবে। থাকার জন্য ভিআইপি হিসেবে কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ নয় মাস নির্জন সেলে বন্দী করে রেখে আমার কাছ থেকে পাকিস্তানিরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। বিশেষ করে তাজউদ্দীন সাহেবের অবস্থান এবং ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার সাথে সম্পর্কের বিষয় জানতে চেয়ে বারবার চাপ দেয়। এমনকি তাদের সহযোগিতা না করলে খারাপ পরিণতির হুমকিও দেওয়া হয়। তারা জানায় যে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেও অনুরূপ তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা তারা করছে। অবশেষে তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে আমার বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে।
পাকিস্তানের বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের নোটিশ আমার কাছে ৫ সেপ্টেম্বর এসে পৌঁছায়। লে. কর্নেল ওয়াজির খান মালিক স্বাক্ষরিত নোটিশে একটি বিশেষ আদালতে অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বিচারকাজ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এদিকে হঠাৎ করেই অক্টোবরের শেষ দিকে সর্বত্র একটি অস্থিরতা পরিলক্ষিত হতে থাকে। বিচারকাজ পিছিয়ে যায়। জেলের রং পরিবর্তনসহ বেশ কিছু তৎপরতা বেড়ে যায়। ঘন ঘন সামরিক বিমানবহরের উড়ে চলা, সাইরেনের শব্দ, জেলসহ সর্বত্র ব্ল্যাক আউটের যুদ্ধের মহড়া ইত্যাদি বেড়ে যায়। নভেম্বর মাসে একদিন সাইরেন বেজে উঠল। লকআপ থেকে বের করে বাইরে শীতের মধ্যে একটি গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। জানতে পারলাম কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশে বোমাবর্ষণ হচ্ছে। তাই আমাকে লকআপের বাইরে আনা হয়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। পরে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটিকে বুঝিয়ে আবার লকআপে চলে গেলাম। এভাবে দিন কাটতে লাগল।
কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর হঠাৎ দেখলাম খাওয়া-দাওয়া পরিবর্তন। তাদের ব্যবহারে পরিবর্তন। এত দিন যেখানে ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাতাম। আজ দেখি আমার রুমে সোফা আনা হচ্ছে, গালিচা আনা হচ্ছে, একটি খাট দেওয়া হচ্ছে। দায়িত্বরত অফিসারকে বললাম, কী ব্যাপার এত মাস পর হঠাৎ এত পরিবর্তন কেন? সঠিক কোনো উত্তর পেলাম না। তবে অনুমান করলাম বাংলার দামাল ছেলেদের কাছে পশ্চিমা আর্মিরা পরাজিত হয়েছে।
অবশেষে ২৮ ডিসেম্বর হঠাৎ করে জেল সুপার এসে আমাকে সব কিছু গোছগাছ করে তৈরি হতে বললে বিস্মিত হলাম। কাপড়-চোপড় এমনকি বই-পুস্তক যা এত দিন জেল কর্তৃপক্ষের হেফাজতে ছিল, সব দিয়ে গেটের সামনে এনে গাড়িতে তুলে আমাকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আনার পর সিহালার নির্মাণাধীন পুলিশ দপ্তরের একটি বাংলোতে নিয়ে যাওয়া হয়; সেখানে ঢুকে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলাম হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৫ মার্চের কালরাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে শেষ সাক্ষাতের দীর্ঘ নয় মাস পর ২৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির সিহালার এক বাংলোতে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। এ সময় আমরা পরস্পর আবেগে জড়িয়ে ধরলাম। বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে পারলাম রাওয়ালপিন্ডির মিওয়ানওয়ালী কারাগারে তাঁকে এই দীর্ঘ নয় মাস বন্দী রাখা হয়েছিল।
এর মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো দেখা করে শিগগিরই আমাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থার কথা জানান। তবে নানা অজুহাতে অহেতুক যাত্রা বিলম্বিত করতে থাকে। বিশেষ করে ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভীর সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি যেকোনো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে যথাশিগগিরই দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ভুট্টোকে চাপ দিতে থাকেন।
অবশেষে ৭ জানুয়ারি রাতে ভুট্টো করাচি বিমানবন্দর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসেন এবং একটি পাকিস্তানি বিমানে করে পরের দিন সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধুসহ আমি লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরে নামি। পাকিস্তান থেকে লন্ডন পর্যন্ত আমাদের যাত্রা গোপন রাখা হয়। লন্ডন থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরত্বের অবস্থান থেকে জানানো হয় যে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঘণ্টার মধ্যে হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। অতি অল্প সময়ের নোটিশে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে ছুটে আসেন স্যার ইয়ান সাউদারল্যান্ড। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদ শোনার সাথে সাথে হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালির সাথে ছুটে আসেন ব্রিটেনের বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারোল্ড উইলসন, সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট, কূটনীতিবিদ রেজাউল করিম, এ কে খান, বেগম আবু সাঈদ চৌধুরী প্রমুখ দেশি-বিদেশি কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ নিজ এলাকা থেকে দ্রুত লন্ডন ফিরে এসে নিজের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত বিমানে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করেন। ওরই মধ্যে ঢাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের সাথে কথা বলে বঙ্গবন্ধুর যাত্রার সময় ইত্যাদি ঠিক করে ফেলা হয়। অবশেষে ৯ জানুয়ারি সকাল ৭টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করে সাইপ্রাস-শারজাহ ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুযারি বিকেল ৩টায় প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশের মাটিতে আমি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবতরণ করলাম।
লেখক : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ