১৭ এপ্রিল
ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম...’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ...’, ‘আমাদের যার যা আছে, তা নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...’—এসব বজ্রকণ্ঠের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। আর তখন থেকেই বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পুরো মার্চ মাসজুড়ে যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই পূর্ব বাংলার সরকারের সব কার্যক্রম চলছিল, তখন দূরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের অপতৎপরতায় বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে হয়তো পাক সরকার মেরে ফেলবে নয়তো গ্রেপ্তার করে ফেলবে। সে জন্য তিনি ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিজের কণ্ঠেই স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন। পরে তা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পরের দিন, অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে বহুবার প্রচারিত হয়েছিল।
এর পর দেশে পুরো মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই পরিকল্পনা করা হয় প্রবাসী ও মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সেই সরকার গঠন করা হয়। তখন সেই সরকার পরিচালনার জন্য একটি ইশতেহার ও ঘোষণাপত্র তৈরি করা হয়। সেই ঘোষণাপত্র মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অন্তর্বর্তী সংবিধান হিসেবে চালানো হয়। পরে সেই মুজিবনগর সরকার ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথবাক্য পাঠ করেন। সেই সরকারে রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী প্রমুখ।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান যেহেতু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন, সে জন্য তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ছিলেন কর্নেল এমএজি ওসমানী। সরকারের আরো সহযোগী ছিলেন প্রশাসনিক সমন্বয়কারী এইচ টি ইমাম, ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ড. মশিউর রহমান, ড. আকবর আলি খান, ড. সা’দত হোসাইনসহ আরো অনেকে এবং সামরিক সমন্বয়কারীদের মধ্যে এ কে খন্দকার, কে এম শফিউল্লাহ প্রমুখসহ আরো অনেকে।
গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার জন্য সে সময় এ রকম একটি সরকার গঠনের খুবই প্রয়োজন ছিল। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সপক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো, দেশ চালানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করা, যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন ও তাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ প্রদান করা, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কৌশলগত কারণে ভাগকৃত ১১টি সেক্টরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন ইত্যাদিই প্রধান। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের সার্বিকভাবে সহায়তাকারী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। সরকার গঠনের জন্য তাই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এমন একটি স্থান বেছে নেওয়া হয়, যেখানে কোনো সমস্যা হলে সহজেই যাতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যায়। তা ছাড়া সেখানকার তৎকালীন যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ থাকার কারণে সহজে পাক আর্মিরা সেখানে পৌঁছতে পারবে না।
দীর্ঘ নয় মাস সেই মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা ও পরিচালনাতেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। অতঃপর স্বাধীনতার পর পাকিস্তানিরা সসম্মানে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিলে তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন। এ সরকারের আমলেই ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে প্রথমে ভারত এবং ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল মুজিবনগর সরকার। কাজেই এ সরকারের মেয়াদকাল ছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে এ সরকারের সফল মেয়াদকাল লেখা থাকবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।