নারী নির্যাতন
তনুরা কি এভাবেই হারাবে?
সোহাগী জাহান তনুর ফেসবুকের প্রোফাইল ঘুরে দেখতে গিয়ে একটি ভিডিও দেখতে পেলাম। তনু সেখানে নিজে গিটার বাজিয়ে গান গেয়েছে। ভিন্ন ভাষার সেই গানটি অনুবাদ করলে একটি লাইন এ রকম হবে- ‘কিছু ভালোবাসা এখনো বাকি’। এত ভালোবাসা বুকে নিয়ে মেয়েটি হারিয়ে গেল! ভালো করেছিস সোহাগী, যে দেশে ধর্ষকরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়, ধর্ষণের বিচার হয় না, খুনের বিচার হয় না, ধর্ষিতাকে সমাজের চোখে অপাঙক্তেয় ঘোষণা করা হয়, সে দেশে ভালোবাসার মতো ফালতু জিনিস আর নেই রে! তোর স্বর্গীয় ভালোবাসা বুকে নিয়ে স্বর্গেই ভালো থাকিস। নরপিশাচদের এই রাজ্য তনুদের জন্য নয়।
তনু হত্যার পর সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও খুনির টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। দেশের যেকোনো ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে বলেই আমরা জানি। এ রকম একটি জায়গাতেও একজন তরুণী নিরাপদ নয়? এ দেশের নারীরা তাহলে কোথায় নিরাপদ? লোকাল বাসে চড়তে গেলে ‘মহিলা’ শব্দটিকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যেন ‘মহিলা’ কোনো মানুষ নয়, মহিলা একটি ইতরশ্রেণির প্রাণীর নাম! সংরক্ষিত নারী আসনগুলোতে বসতে গিয়েও নারীদের প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হয়! এ দেশে প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেতা নারী, আরেকটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী, মহান সংসদের স্পিকার- তিনিও নারী। অথচ নারীর মূল্যায়ন কোথায়! নারীর নিরাপত্তা কোথায়! একজন নারী, সে যত বড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন, একজন পুরুষ ড্রাইভার বা বাসের হেলপার এমনকি রিকশাচালকের চোখেও সে কেবলই নারীই থেকে যাচ্ছে! এই নারী বলতে যদি তারা মমতাময়ী মায়ের কথা ভাবত, প্রিয় বোনটির কথা ভাবত, তবে আর এত সমস্যার সৃষ্টি হতো না। নারী যে ভোগের বস্তু নয়, এই শিক্ষা পুরুষরা কবে রপ্ত করবে!
তনুর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। পত্রপত্রিকা ও ফেসবুকে যতটুকু পড়েছি, দেখেছি তাতে বোঝা যায়, চমৎকার এই মেয়েটি ছিল ভীষণরকম গুণবতী। সুরেলা ছিল তার কণ্ঠস্বর। হয়তো পরে সংগীতবিষয়ক কোনো ট্যালেন্ট হান্টে সেই হতো দেশের সেরা! ভাইয়ের জন্য নিজ হাতে রান্না করা খাবারের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিল তনু। তেহারি, মাগুর মাছের ভুনা, মাংস ভুনা, সালাদ, ডিম দিয়ে সাজানো প্লেট। এই মেয়েটিই যে পরবর্তী সময়ে দেশের সেরা রাঁধুনি হতো না, সে কথা কে বলতে পারবে! ভাবতেই কলিজা পুড়ে যাচ্ছে যে, এমন অপার সম্ভাবনাকে এমন করুণভাবে বিদায় নিতে হচ্ছে! দেশের ভবিষ্যৎ এসব সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব মূলত কার? আমি মনে করি, দেশের প্রত্যেকটি মানুষের। যে যার নিজের অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলেই সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ অগ্রসর হবে। এই যে ধর্ষক ও খুনিরা ধরা পড়ছে না অথবা তাদের ধরা হচ্ছে না, এতে করে কি আমাদের ছত্রছায়াতেই একটি ধর্ষক প্রজন্ম বেড়ে উঠছে না? একদিকে প্রতিভাবানদের করুণ মৃত্যু, অপরদিকে খুনিদের বেঁচে যাওয়া, এর ফলে মূলত আমরা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি। বিবেকহীন জাতি তৈরির দায় নিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত কি আমাদের হুঁশ ফিরবে না!
একবার আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমার বড় বোনটিকে কেউ খুন করেছে। তার ছোট ছোট দুটি ছেলেমেয়ে মায়ের জন্য কেঁদে অস্থির। আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি, জনে জনে বলছি, ‘ভাই, আমার বোনটিকে খুন করা হয়েছে, আমি এর বিচার চাই, আপনারা এর বিচার করুন। বোনের ছেলেমেয়ে দুটি এখন কার কাছে যাবে, ওদের কী হবে! কেন আমার বোনটিকে খুন হতে হলো!’ দেখলাম, আমার এমন আর্তনাদ শুনেও কেউ কোনো সাড়া দিচ্ছে না। আমাকে পাশ কাটিয়ে যে যার কাজে চলে যাচ্ছে। নিছকই স্বপ্ন ছিল। অথচ তারপর যতবারই সেই দৃশ্য, সেই স্বপ্নের কথা আমার মনে পড়েছে, প্রতিবারই আতকে উঠেছি! তনু আমার বোন নয়, অন্য কারো তো বোন, মেয়ে। একটি দুঃস্বপ্ন দেখেই যদি আমার এমন প্রতিক্রিয়া হয়, সেখানে তনুর মা-বাবা, ভাই-বোন, প্রিয়জনের মনের ভেতরে কী বয়ে যাচ্ছে!
আচ্ছা, ধরলাম, তনু খুন হলো না। শুধু ধর্ষিত হলো। সেই তনুকে এই সমাজ কি গ্রহণ করত? তনু ধর্ষিত হওয়ার পর যখন পুলিশের কাছে গিয়ে বলত, ‘আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে’, সে কতটুকু সাহায্য পেত? যেখানে তার খুনের বিচারের নিশ্চয়তাই এখনো দোদুল্যমান। একজন ধর্ষিতা মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী করার মতো পুরুষ কি একজনও আছেন এই দেশে! ধর্ষিতার সামাজিক অবস্থান জঞ্জালমুক্ত রাখার মতো সমাজ আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি। তাই যদি পারতাম, তাহলে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ তৈরি হতো না। তনু বরং খুন হয়েই বেঁচে গিয়েছে। বেঁচে থাকলেও তো তাকে সমাজের মানুষরাই তিলে তিলে মেরে ফেলত! এ সমাজে ধর্ষক শুধু একাই ধর্ষক নয়, তাকে আশ্রয়দানকারী, সব দেখেও চুপ থাকা মানুষরা প্রত্যেকেই ধর্ষক। আজ আরেকজনের বোনের ধর্ষণের বিচার চেয়ে আপনি প্রতিবাদ না করলে ধর্ষকের হাতটি আরেকটু লম্বা হয়ে আগামীকাল আপনার বোনের কাছেই পৌঁছাবে।
তনুর মননে বাস করত শিল্পীসত্তা। একটি সুরেলা কণ্ঠস্বর, একটি মায়াবী মুখ, একটি দুর্দান্ত প্রতিভাকে এমন দপ করে নিভিয়ে ফেললে জাতিকে তো অন্ধকারেই ধাবিত হতে হবে, নিক্ষিপ্ত হতে হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, যেখান থেকে কেউ কোনোদিন ফিরে আসেনি।
লেখক : সাংবাদিক, জাগো নিউজ২৪ ডট কম।