আয়নায় প্রতিফলিত দাউদাউ আগুন
চোখ খুলতেই দেখি, আয়নায় প্রতিফলিত আগুন। দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখা আমাকে বিমূঢ় করে তোলে। বুঝতে পারি, বিছানা-বালিশের স্পর্শচ্যুত হয়ে আমি শূন্যে উঠে গেছি। দেখতে পাই, পাশের বাড়ির লুলু মামার কোলে আমি। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুনতে পাই থ্রি নট থ্রির একটি গুলির আওয়াজ এবং তার পরপরই কানে তালা লাগানো স্টেনগানের ধারাবাহিক গান। সে আওয়াজ আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় মনে।
না, পাঁচ বছর বয়সে থ্রি নট থ্রি বা স্টেনগানের নাম জানতাম না আমি। তবে পরে, বড় হয়ে বারবার সে ঘটনা মনে করার চেষ্টা করেছি, এ বিষয়ে পড়েছি, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছি, তারপর শব্দগুলোকে বুনেছি নিজের মতো করে।
আয়নার সেই আগুনই আমার শিশু মনকে তৈরি করে দিল। ‘যুদ্ধ বেঁধে গেছে’ এ কথা না বোঝার কোনো কারণ ছিল না। লুলু মামার কোলে করে আমি তখন এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছি আর দেখতে পাচ্ছি পুলিশের পোশাক পরা অসংখ্য মানুষ, নারী ও পুরুষ, আমাদের বাড়িতে ঢুকছে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদের আওয়াজ, তারই ওপর ফোড়ন কাটছে ধারাবাহিক গুলি। কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো গুলির শব্দ আমাদের শিশু মনকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল। আমরা এ রকম দৃশ্য কল্পনাতেও আনতে পারিনি আগে। আগে শুধু দেখেছি মিছিল, নৌকা, বঙ্গবন্ধু! আগে শুধু শুনেছি গণসংগীত। আগে শুধু দেখেছি, ডামি রাইফেল হাতে পাড়ার বড়ভাইদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার দৃশ্য। সত্যিকারের যুদ্ধ কেমন হয়, সেটা একেবারেই জানা ছিল না আমার এবং আমাদের। আমরা সেই যুদ্ধের মধ্যেই আটকে গেলাম।
ওই দাউদাউ আগুন জ্বলছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। ২৫ মার্চ মাঝরাতের পরই ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান। ভয়ানক আতঙ্ক ছড়িয়ে, মানুষ মেরে ওরা এ দেশের ক্ষমতায় আরো পোক্ত হয়ে বসবে—এই ছিল ভাবনা। ওরা জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল পুলিশ লাইন, পিলখানা। ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোয়, বিশেষ করে জগন্নাথ হল ছিল ওদের মূল টার্গেট। ওরা আক্রমণ করেছিল পত্রিকা অফিসে—ইত্তেফাক, সংবাদ আর দ্য পিপল রক্ষা পায়নি ওদের গোলার আঘাত থেকে।
শৈশবের সেই নির্দিষ্ট দিনটি এখনো ঝলক দিয়ে ওঠে মনে। অন্ধকার রাতে হঠাৎ আলোর ঝলকানি ও প্রচণ্ড শব্দে গোলাবর্ষণের বিভীষিকা আজও ভুলতে পারি না। পাঁজাকোলা করে তুলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাশের বাড়িতে, যেখান থেকে সরাসরি এই আগুন দেখা যায় না। কিন্তু একটু পর সবাই ভুলে যায় আমাকে। আরো অনেক কাজ ছিল বড়দের কিংবা তাঁরাও ছিলেন আতঙ্কিত। তাই সবার খবর রাখার হয়তো সুযোগ ছিল না। গভীর রাতে আমি আবার ফিরে আসি আমাদের বাড়িতে। সেখানে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ে। আমাদের কাঠের আলমারি খুলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের আতঙ্কিত পুলিশরা আব্বার শার্ট, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, লুঙ্গি পরে নিচ্ছেন। ফেলে রেখে যাচ্ছেন পুলিশি ইউনিফর্ম। এদেরই মধ্যে সাহসী কেউ কেউ উঠে যাচ্ছেন একতলা বাড়ির ছাদে। সেখান থেকে চালাচ্ছেন থ্রি নট থ্রির ‘ঠুস’। উত্তরে পাকিস্তানিরা আমাদের স্নান করাতে লাগল আগুনের ফল্গুধারায়। বড়ভাইরা চিৎকার করছিলেন, ‘আপনারা এখান থেকে গুলি করবেন না!’
কিন্তু কে শোনে কার কথা। থ্রি নট থ্রির অসহায় গুলি ছুটে যেতে লাগল শূন্যে, আর তার উত্তরে চলতে লাগল অগুনতি গুলির আতঙ্ক-জাগানিয়া দুর্বোধ্য সংগীত।
আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম, দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। পুলিশ বাহিনীর প্রাথমিক প্রতিরোধ ভেঙে গেছে। এরপরও লড়ছে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে। আমার মনে পড়তে লাগল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিশাল বড় মাঠটির কথা। ‘নীল সাগর’ নামে বড় দীঘি থেকে খানিকটা দূরে ছিল এই মাঠ। পাড়ার বড় ছেলেরা খেলত সে মাঠে। আমরা দর্শক হয়ে সে খেলা দেখতাম। তখন আমাদের চামেলীবাগপাড়ায় চামেলী সংঘ ও চামেলী খেলাঘর নামে দুটি ক্লাব ছিল। তাদের মধ্যে মাঝেমধ্যে খেলা হতো। আর ছিল নীল সাগরের পাড়ে একটা আস্তাবল। পুলিশের দুর্দান্ত তাগড়া ঘোড়াগুলো থাকত সেই আস্তাবলে। আমরা গভীর মনোযোগের সঙ্গে সেই ঘোড়াগুলো দেখতাম, সহিস এসে কখন ওদের খাওয়াচ্ছে, কখন কোন ঘোড়া দাঁড়াচ্ছে, কখন বসছে, সব হিসাব রাখতাম আমরা। আর সবচেয়ে ভালো লাগত রোদে আস্তাবলের বাইরে এনে ঘোড়াকে দলাই-মলাই করার দৃশ্য। আজও, এত বছর পেরিয়েও সে দৃশ্য চোখে লেগে আছে। তখন এত সব মনে হয়নি। শুধু মনে হয়েছে, পুড়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় মাঠ! কেন পুড়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছিলাম না আমরা। কিন্তু কারা পোড়াচ্ছে, সেটা জানার মতো রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলাম আমি এবং আমার মতো শিশুরা। তখন সবাই ছিল রাজনীতিসচেতন। তখন সবাই জানত, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার কথা।
সেই আতঙ্ক ছড়ানো রাত শেষ হয় একসময়। ভোররাতের দিকেই গোলাবর্ষণের শব্দ ফিকে হয়ে আসে। কখনো হঠাৎ দু-একটি বিচ্ছিন্ন গুলির শব্দ মনকে চমকে দেয় না আর। খুব ভোরে মেজ মামা তাঁর অফিস থেকে ফিরে আসেন। ফিসফিস করে কথা বলেন বড়দের সঙ্গে। সবাইকে বিচলিত লাগে। আস্তে আস্তে আমাদের কাছেও বিষয়টা পরিষ্কার হয়। আগের রাতে আমাদের রাজারবাগের মতোই ইত্তেফাক অফিসেও চলেছে গুলি, চলেছে কামানের গোলা। আব্বা ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন রোডে ইত্তেফাক অফিসে। ইত্তেফাকের প্রেস পুড়ে গেছে, যারা অফিসে ছিল, তারা কেউ বেঁচে ফিরে আসতে পারবে কি না, তা নিয়ে ছিল সংশয়। আমরা পুরো পরিবার হঠাৎ করে মুহূর্তের মধ্যে শূন্যতায় ভাসতে লাগলাম।
আব্বা ফিরেছিলেন ২৭ মার্চ। এরপর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাতেই ছিলেন। এ সময় ইত্তেফাকে লিখেছেন তাঁর সাহসী লেখাগুলো। পুরো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতেই জামাতিদের পত্রিকা সংগ্রাম আব্বাকে হুমকি দিয়ে গেছে। তারপর ১০ ডিসেম্বর, দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার মাত্র ছয় দিন আগে আমাদের জীবনে ঘটে যায় সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সে গল্প অন্য সময়।
লেখক : ডেপুটি ফিচার এডিটর, দৈনিক প্রথম আলো।