স্মরণ
রাজু আমাদের চেতনার স্ফুলিঙ্গ
মঈন হোসেন রাজু একটি নাম। যাঁর রক্তাক্ত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) প্রাঙ্গণে একটি ভাস্কর্যের মাধ্যমে।
১৯৯২ সালের এই দিনে বাম সংগঠনগুলোর সম্মিলিত ব্যানার গণতান্ত্রিক ছাত্রঐক্যের মিছিলে গুলি করে তৎকালীন ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা। সেই দিনের শুক্রবারের সন্ধ্যাটি আজও এক ইতিহাসের পাতায় খোদিত রয়েছে।
কী হয়েছিল সেই দিন? কেনই বা গুলি করা হয়েছিল?
সেই দিন ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছিল দফায় দফায় বন্দুকযুদ্ধ। হল দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভয়ে একদম তটস্থ। নবীন শিক্ষার্থীদেরও জোর করে উভয় সন্ত্রাসী গ্রুপ ব্যবহার করছিল নিজেদের দলে। এ অবস্থায় রাজুদের মতো শান্তিকামী ছেলেরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল বের করে, যাতে করে সন্ত্রাসীরা পিছু হটে আর সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসতে পারে। তাদের ভয় কাটতে পারে। কিন্তু ছাত্রদলের কিছু সন্ত্রাসী তাদের বন্দুকের নল তাক করে প্রগতিমনা এই মিছিলটির দিকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাজু।
রাজু ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বেড়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। পড়াশোনার হাতেখড়ি বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন ও মা খাদেজা বেগমের হাতেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেতা ছিলেন। শেরেবাংলা নগর ও তেজগাঁও কলেজসহ ওই অঞ্চলে ছিল তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড।
১৯৮৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করা ছেলেটি প্রাচ্যে ভর্তি হয়েছিলেন মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে। দেখতে ছোটখাটো হলেও মানুষটি ছিলেন গণতন্ত্রের জন্য এক দিব্যমান পুরুষ। নব্বইয়ের স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যেখানে রাঘববোয়ালরা ছিল ভয়ে কুপোকাত, গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল নিজেদের—তখন রাজুদের প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড আজো ইতিহাসের পাতায় প্রজ্জ্বলিত।
স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে রাজুর নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো।
ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই শহীদুল্লাহ হল কমিটির সদস্য হন। তার পর দায়িত্ব পান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ সম্পাদক হিসেবে। একই বছর (১৯৯১) ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও মনোনীত হন তিনি। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, তখনকার ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীসংখ্যা ও কার্যপরিধি আজকের দিন দিয়ে হিসাব কষলে ভুল হবে।
রাজুরা চলে গেছেন। তাঁদের মাথার মস্তক মিশে আছে পিচঢালা রাস্তার নিচে। কিন্তু আজো থেমে নেই বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম।
যে ক্যাম্পাসে রাজুর ভাস্কর্য দিব্যমান, সেই ক্যাম্পাসেই কি আর প্রাণ ঝরেনি? আবু বকরদের মতো নিরীহ ছাত্ররা কি নিরাপদ আছে তাদের পড়ার টেবিলে?
বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য ক্যাম্পাসে প্রতিবছরই ঝরছে নতুন নতুন প্রাণ। বিশেষ করে দলীয় লেজুরবৃত্তিক সন্ত্রাসী রাজনীতি দিন দিন বেড়েই চলছে। আর রাজুদের বিদেহী আত্মা অদৃশ্যে গুমরে কাঁদছে।
১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এ. কে. আজাদ চৌধুরী। ভাস্বর শ্যামল চৌধুরী ও গোপাল পালের হাতে নির্মিত হয়েছে সন্ত্রাসীদের ঘৃণার প্রতীক এই চেতনাফলকটি।
মা খাদিজা বেগমের হৃদয় ফাটা অশ্রুচারণ, ‘আমার জীবনের যত সাধনা, আকাঙ্ক্ষা ফানুসের মতো চুপসে গেল শুধু একটি টেলিফোনে। তখনো ভাবতে পারিনি, আমার রাজু মারা গেছে! সৃষ্টিকর্তার কাছে ওর প্রাণভিক্ষে চাইতে চাইতে ছুটে গেছি মেডিকেলে। দেখতে দিল না আমাকে। বাবু (বড় ছেলে) কাঁদছে আমাকে জড়িয়ে ধরে, রাজুর বন্ধুরাও কাঁদছে। ওরা আমাকে বাসায় চলে যেতে বলছে। ডাক্তার নাকি সুস্থ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাজু একটু সুস্থ হলেই বাসায় নিয়ে আসবে ওরা। তখনো বুঝতে পারিনি, তপ্ত বুলেট ওর মাথা ভেদ করে কপাল দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’
এভাবেই হাজারো রাজুর মা তাঁদের সন্তান হারিয়ে নাড়িছেঁড়া স্মৃতিচারণ করে যাচ্ছেন। আর প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রতি, ‘আর কত প্রাণ পেলে আপনাদের রক্ততৃপ্তি পূর্ণ হবে?’
একবুক হাহাকার নিয়ে মাত্র ৬৭টি বছর বয়সে এই মা-ও না-ফেরার দেশে চলে গেছেন গত বছরের ৫ অক্টোবর। কিন্তু আমাদের সামনে রেখে গেছেন হাজারো জিজ্ঞাসা।
লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।