ক্রিকেট
বিশ্বকাপ একদিন আসবেই এই বাংলার ঘরে
ভারতীয় অধিনায়ক এম এস ধোনি মুখ ভোঁতা করে বাম পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে বৃত্ত আঁকছেন। মাঠের ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টে! চোখের পাতা নামাতে ভয় পাচ্ছেন। যে কোনো মুহূর্তে কেঁদে ফেলবেন! এক ফাঁকে অজান্তেই চোখের পাতা এক হয়ে গেল তাঁর। অমনি টপাটপ কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে নামল চোয়াল বেয়ে! বেচারা!
নিজের দেশের মাটিতে টি-২০ বিশ্বকাপ! সেই কাপ হাতছাড়া হয়ে গেলে না কেঁদে উপায় আছে? উপায় নাই। শুধু ধোনি কেন, কোহলি, শর্মা, রাইনা, পান্ডে কেউ কারো মুখের দিকে তাকাচ্ছেন না। অসহ্য যন্ত্রণায় মাটির ভেতর ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে সবার। সেটারও উপায় নেই।
অথচ ঘণ্টা কয়েক আগেও ১৯৫ রানের পাহার গড়া ভারতীয় খেলোয়াড়রা লাফাচ্ছিলেন আনন্দে! আরেকবার সোনার বিশ্বকাপটাকে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ। ঘরের কাপ ঘরে রাখার আনন্দ! সেই আনন্দের টগবগ করা গুড়ের কড়াইতে কিনা লাখ লাখ বালি ঢেলে দিল কোথাকার কোন বঙ্গদেশের হালকা পাতলা গোনায় না ধরা টাইপের ছেলেপেলে।
টাইগার শিবিরে তখন বাঁধভাঙা উল্লাস! উল্লাস আর কী? বাঁধভাঙা কান্না আসলে! ওই দিকে ভারতীয়রা কাপ হারানোর দুঃখে কাঁদে। এদিকে টাইগাররা জীবনে প্রথমবার কাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপের সোনার হরিণ ছুঁয়ে দেখার আনন্দে কাঁদে। ওদের কান্নার চেয়ে টাইগারদের কান্নার গতিবেগ ঘণ্টায় কয়েক শ মাইল বেশি! বাংলাদেশ আজ বিশ্ব জয় করেছে! সমগ্র বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে নিজেদের ঘরে তুলে নিয়েছে স্বপ্নের বিশ্বকাপ!
ডেনজারম্যান তামিম কিনা আজ বলকে ফুটবল দেখল চোখে! তার হাতের ব্যাটকে মনে হলো হাত দুই চওড়া কোনো কাঠের গদা! বল আসলেই হেইয়ো! চারে ছয়ে একাকার! বাংলাদেশের পক্ষে টি-২০ বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি! এরপর যেই গেল সবাই, একেকটা টর্নেডো হয়ে গেল মাঠে! সাব্বির, সৌম্য, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ সবাই ছুটল ঘূর্ণিঝড়ের গতিতে! পান্ডে, নেহরা, বোমরারা উড়ে গে ভারতীয়রা সেই ঝড়ে! মাত্র ২০ ওভারে ১৯৫ রান কোন ফাঁকে যে হয়ে গেল পাঁচ বল বাকি থাকতেই ব্যাটসম্যানরা টেরই পেল না। বাংলাদেশ গড়ে ফেলল বিস্ময়কর এক ইতিহাস!
হাঁটু নড়বড়ে কোটিতে বাটি লাগানো ছেলেটা তখন সাক্ষাৎকার দিতে এসেছে লাল-সবুজের পতাকা মাথায় বেঁধে। একটু পরপর ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করছে। বাচ্চা ছেলেপেলের মতো নাক টানছে আজ। দুই হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে বারবার ভিজে ওঠা চোখের পাতা শুকাতে ব্যস্ত ছেলেটা।
ধারাভাষ্যকার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার অনুভূতি কী?
সুরুত করে নাকটা ভেতরে টান দিয়ে আধাবন্ধ গলায় বলল মাশরাফি- আমরা লড়াই করে জিততে জানি! এ অর্জন আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদের। আমার বাপ-দাদার রক্তে অর্জিত দেশের ১৬ কোটি মানুষের এ বিজয়। এ বিজয় লাখ লঅখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের! সবার তরে উৎসর্গ করলাম আমাদের এবারের বিশ্বকাপ! সামনে আবার বিশ্বকাপ জিতব আমরা! একে একে সবাইকে উৎসর্গ করব! সবে তো খেল শুরু..!
বিশ্ব হয়তো কিছুক্ষণের জন্য বাকশক্তি হারিয়ে ফেলবে। বাঘা বাঘা ক্রিকেটাররা ফেসবুকে টুইটারে কী বলবে তার ভাষা খুঁজে পাবে না।
হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন, স্বপ্নই দেখছিলাম! এমন একটা স্বপ্ন আমার বহুদিনের! স্বপ্ন দেখতে কি আর পয়সা লাগে? লাগে না। দেখবই যখন, বড়সড়ই দেখি। জানি, অনেকে ভাবছেন, পরপর কয়েকটা ম্যাচ জিতেছে আর বামুন হইয়া চাঁদের পানে হাত বাড়াইতে মন চায়? পরের ম্যাচেই তো গু হারা হারবে! আমিও বলি, হারুক। তারপরও আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখবই! দেখবই দেখব!
এইবারে পারবে না, না পারুক! এই টিম পারবে না, না পারুক! সাকিব তামিম মাশরাফি মুশফিকরা পারবে না, না পারুক! আমি জানি একদিন ঠিকই পারবে। এরা পারবেই। এরা না পারলেও এদের উত্তরসূরিরা পারবে! একদিন ঠিকই সাকিবের মতো আরো কয়েকজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আসবে টাইগার টিমে! একদিন ঠিকই কোনো এক হাঁটুর বাটি খুলে যাওয়া মাশরাফি আবার আসবে নেতৃত্ব দিতে অন্য নামে! একজন মুশফিক আসবেই হাসিমুখে মাথা ঠান্ডা রেখে পাহার ডিঙাতে! ওরা আসবেই! এ আমার বিশ্বাস! স্বপ্ন। পারলে ঠেকান!
একসময়ের সম্মানজনক হারের প্রত্যাশী দলটা এখন ঘোষণা দিয়ে যে কোনো দলকে বিট করতে পারে। ক্রিকেট জন্ম দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের কাঁচকলা দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দিতেন, বড়বড় হুমড়িতুমড়ি করা সব দলকেই কাচুমাচু মুখে বসাতে পারে বাঘের গর্জনে। এরা যে একদিন ওই কাপটাও ছিনিয়ে আনবে সেটা বলতে গণক হতে হয়? হয় না!
এখন সাকিব মাশরাফি মুশফিক নাসিররা যে-ই সামনে পড়ুক, ধরে দিবানি মনে করে নামে মাঠে! জয়ই যাদের একমাত্র লক্ষ্য! সম্মানজনক পরাজয়ের দিন বাঘে খাইছে। বিশ্বকাপটাও একদিন ঠিক এই বাঘেই খাবে! তখন খাওয়া ও খাওয়ার অর্থ হয়ে যাবে ভিন্ন! বিশ্ব কেবল অবাক তাকিয়ে দেখবে চেয়ে চেয়ে!
এগিয়ে যাও বাংলাদেশ!
বিশ্বকাপ একদিন আসবেই এই বাংলার ঘরে...
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।